পাখির কিচিরমিচির শব্দে সকালের ঘুম ভাঙ্গে অধরার। শহরের ইট-পাথরের বড় বড় দালানকোঠার ভিড়ে সকালবেলা পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনা করার মত একটা ব্যাপার। অধরার বাবা সরকারি চাকুরী করেন সেই সুবাদে সরকারি একটি দোতলা বাংলোতে থাকে অধরারা। বাসার চারপাশ গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। তাই ভোরবেলা পাখির কিচিরমিচির এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ঘুম থেকে উঠেই দক্ষিণের জানালাটা খুলে দেয় অধরা। ভোরের আলো আর শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায় অধরাকে।
গতকাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে তাই আজ সকালের আবহাওয়াটা অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন। ভোরের প্রকৃতির মোহনীয় রুপ মুগ্ধ করে যায় অধরাকে। এক দৌড়ে ছাদে চলে যায় অধরা,দুহাত দুইদিকে প্রসারিত করে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে। দুরন্ত হাওয়া এসে বারবার অধরার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়,বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় অধরা। ভিতরে ভিতরে অন্যরকম একটা ভাললাগা কাজ করতে থাকে তার। জীবনটাকে অনেক রঙিন মনে হয় তার। কিছুক্ষণ পর মায়ের ডাক শুনে নিচে নেমে আসে অধরা। নিচে এসে অধরা দেখে টেবিলে নাস্তা রেডি আর তার বাবা অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসে অধরা আর তারপর বাবা,মা,মেয়ে তিনজনে মিলে একসাথে সকালের নাস্তা করে। একমাত্র মেয়েকে খুব ভালোবাসেন মিস্টার সেন তাই শত ব্যাস্ততার মাঝেও মেয়েকে সময় দিতে তিনি কখনও ভুলেন না। সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার সবসময় মেয়েকে সাথে নিয়েই করেন মিস্টার সেন।
মিসেস সেন ও কম ভালোবাসেন না মেয়েকে। অধরা তাই অনেক আদরের মাঝেই থাকে সবসময়। একমাত্র মেয়ে হিসেবে অধরার আহ্লাদ এর কোন শেষ নাই। মেয়ের প্রতিটি শখ আহ্লাদ পূরণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন দুজনেই। সব মিলিয়ে তিনজনের ছিমছাম পরিবারটি সুখি একটি পরিবার। নাস্তা শেষ করে কলেজের জন্য ঝটপট করে রেডি হয় অধরা।
আজ কলেজে কালচারাল প্রোগ্রাম আছে সেখানে একটি একক নৃত্য পরিবেশন করবে অধরা আর তাই বেশ কিছুদিন ধরে অনেক প্র্যাকটিস করেছে সে,আজ কলেজে গিয়ে শেষ রিহার্সাল দিতে হবে। রিকশা করে রওনা দিল অধরা। রিকশায় ভ্রমন তার ভীষণ প্রিয় তাই মাঝে মাঝে ক্লাস শেষে কোন এক বান্ধবীকে নিয়ে বেরিয়ে পরে রিকশা ভ্রমনে। কলেজের সকালের ক্লাসটি করেই সোজা অডিটোরিয়ামে চলে যায় অধরা। দুপুর পর্যন্ত টানা রিহার্সাল করে,তারপর ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার শেষ করে বন্ধুরা মিলে জমপেশ আড্ডায় বসে অধরা। আড্ডার টপিক রিহার্সালে কে কোন ভুল করেছে, কে কি মজা করেছে আর কোন বড় ভাইয়া কোন জুনিয়রের সাথে টাংকি মেরেছে ইত্যাদি। বিকেল হতেই আড্ডা শেষ হয় ওদের। তারপর সবাই প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। প্রোগ্রাম শেষ হয় সন্ধ্যার একটু পরে।
সবাই যে যার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। সবার চোখেমুখে সফলভাবে প্রোগ্রাম শেষ করার খুশি। অধরার খুশিটা একটু বেশি কারণ সবাই তার নাচের অনেক প্রসংশা করেছে। নাচ নিয়ে অধরার অনেক স্বপ্ন। একদিন সে খুব বড় একজন নৃত্যশিল্পী হবে এটাই তার লক্ষ্য। ঘরে ফিরে এসেই অধরা তার মাকে নিয়ে গল্প করতে বসে যায়। আজ কি কি হয়েছে ভার্সিটিতে আর কে কি কমেন্ট করেছে তার নাচ সম্বন্ধে ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এটা অধরার প্রতিদিনের রুটিনে পরে গেছে। সারাদিন কি কি করেছে সেটা মাকে না বলা পর্যন্ত তার শান্তি হয় না। গল্প শেষ করে অধরা তার রুমে চলে যায় আর মিসেস সেন চলে যান রান্নঘরে।
সারাদিনের মেঘলা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমে আসে। অধরার মনটা আজকে অনেক খুশি তাই হটাৎ করে মাথায় ভুত চাপে বৃষ্টিতে ভিজার। সাথে সাথে দৌড়ে ছাদে চলে যায় অধরা আর দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে থাকে,মনে মনে ভাবতে থাকে জীবনটা অনেক রঙিন,অনেক স্বপ্নময়। সব মিলিয়ে অনেক ভালো আছে সে। জীবন থেকে যতটুকু পেয়েছে তাতেই সে অনেক খুশি এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই তার। বৃষ্টিবিলাস করতে করতে আনমনে অধরা তার প্রিয় গানটি গেয়ে উঠে,
“দেখেছ কি তাকে ঐ নীল নদীর ধারে,
বৃষ্টি পায়ে পায়ে,তার কি যেন কি নাই;
জলে ভেজা মাঠে আকাশে হাত বাড়ায়,
মেঘের আড়ালে ভেসে থাকা সেই রংধনুকে চায়।
ঝরাপাতা উড়ে তাকে ছুঁয়ে বলে যা,যারে
এখানে বড়ই ফিকে সব তুই যা;
তাই সে যায়,ছুটে বেড়ায়,ধূসর প্রান্তরে
মেঘের গায়ে হাত বুলায় রংধনুকে চায়”।
২.
অধরা, অধরা.....................অনবরত ডেকে চলেছেন মিসেস সেন। আচমকা আড়মোড়া ভেঙে উঠে পরে অধরা। তারপর অজানা এক অপরাধী ভঙ্গি নিয়ে কিছুক্ষণ মা’র দিকে তকিয়ে থাকে সে। মিসেস সেন মেয়ের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারেন কোন এক সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে ব্যাস্ত ছিল তার মেয়েটি। এটা তার কাছে নতুন কিছু না কারণ অধরা প্রায়ই স্বপ্ন দেখে আর ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করে। মিসেস সেন তখন মেয়েকে কোনভাবেই সান্ত্বনা দিতে পারেন না। তাই আজ সব বুঝেও না বুঝার ভান করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,তোমার বাবা অপেক্ষা করছেন তাড়াতাড়ি নাস্তার টেবিলে এসো।
যাওয়ার আগে খাটের পাশ থেকে স্ক্রেচ দুটো মেয়েকে এগিয়ে দেন মিসেস সেন। অধরার চোখদুটো তখন জলে ছলছল করছে। মেয়ের স্বপ্নে ভরা চোখদুটোর দিকে তাকানোর সাহস হয় না মিসেস সেনের। প্রতিটা দিন মেয়ের মুখের দিকে তাকালে নিজের অপরাধবোধটা বেড়ে যায় তার। ঠিক সময় যদি মেয়ের পোলিও টীকাটা দিতে পারতেন তাহলে হয়ত তার মেয়েও অন্যান্য মেয়েদের মত স্বাভাবিক হত,দৌড়ঝাঁপ করতে পারত।
প্রতিদিনের মত আফসোস করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যান তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পরে অধরা, তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে যায়। সবার সাথে নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে ফিরে আসে অধরা। ইদানিং অসুস্থতা একটু বেড়েছে তাই ঠিকমত কলেজে যেতে পারে না সে। সারাদিন গল্পের বই পড়ে, গান শুনে আর টিভি দেখে সময় কেটে যায় অধরার। নাচ অধরার খুব প্রিয় তাই টিভিতে কোন নাচের প্রোগ্রামই সে মিস করে না। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা বন্ধুরা আসে তার সাথে দেখা করতে, আড্ডা মারতে মারতে তখন সময়টা মোটামুটি ভালোই কেটে যায় তার। আসলে মা-বাবার ভালবাসা আর সার্বক্ষণিক যত্ন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্পের বই, গান শোনা আর নাচ নিয়ে খুব একটা খারাপ নেই অধরা।
তবুও মাঝে মাঝে যখন স্বপ্নগুলো চোখের সামনে এসে পরে তখন নিজেকে আর সামলাতে পারে না অধরা,তখন জীবনটা শুধুই ধূসর মনে হয় তার কাছে। স্বপ্নের গাড় রঙগুলো সামনের সবকিছুকে তখন ঝাপসা করে দেয়। আজও বিকেলবেলা তার কয়েকজন বন্ধু তাকে দেখতে আসলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশ জমপেশ একটা আড্ডা হয়ে গেল। বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে, তাই সন্ধ্যে হতেই সবাই যে যার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা ভালো কাটে অধরার কিন্তু বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর হটাৎ একরাশ শুন্যতা এসে গ্রাস করে অধরাকে। বাইরে সারাদিনের মেঘলা আকাশ ভেঙ্গে একটু পরে বৃষ্টি নামে,অঝোর বৃষ্টি।
অধরার খুব ইচ্ছে করে ছাদে উঠে এই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে,বৃষ্টির জলে নিজের দুঃখগুলো ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে তার খুব কষ্ট হয় তাই ইচ্ছেটাকে মনের ভিতরেই কবর দেয় অধরা। রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে,পিসি থেকে নিজের প্রিয় গানটা ছেড়ে জানালার পাশে এসে বসে অধরা। জানালার পাশে বসে একমনে বৃষ্টি দেখতে থাকে অধরা আর ভাবতে থাকে কবে তার অধরা স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে ধরা দিবে। জীবনটা তার কাছে অনেক ধূসর অনেক নিষ্প্রাণ মনে হয়। জীবনটা বোধয় এমনই,কিছু কিছু স্বপ্ন সারাজীবন অধরা থেকে যায়। জীবন থেকে মানুষ যতটা চাই ঠিক ততটাই পায় না। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, বাঁচতে হবে বলেই হয়তো বেঁচে থাকে। দু-এক ফোঁটা অভিমানী বৃষ্টি অধরার দুচোখ বেয়ে নেমে আসে যার সাক্ষী হয়ে থাকে কাঠের জানালাটা, মেঘলা আকাশটা আর সারা ঘরময় বাজতে থাকা গানটা,
“দেখেছ কি তাকে ঐ নীল নদীর ধারে,
বৃষ্টি পায়ে পায়ে,তার কি যেন কি নাই;
জলে ভেজা মাঠে আকাশে হাত বাড়ায়,
মেঘের আড়ালে ভেসে থাকা সেই রংধনুকে চায়।
আনমনা মেঘ দূরে যায় কেন কে জানে?
কিছুতেই তার কাছে ধরা দেই না, না না;
তবুও তার মেঘে উড়ার অন্তহীন টানে,
ভিজে হাওয়ায় পাখিরা গায়,রংধনুকে চায়।
জানি একদিন মেঘের ঠিকানা সে পাবে,
বলবে পাখিরা ওরে মেঘ তুই গা, গা গা;
তোর কাছেই আসবে গান তোর কাছেই যাবে,
যারা হারায় রুপকথায় রংধনুকে চায়”।
লিখেছেন - সত্যজিৎ রায় |
গতকাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে তাই আজ সকালের আবহাওয়াটা অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন। ভোরের প্রকৃতির মোহনীয় রুপ মুগ্ধ করে যায় অধরাকে। এক দৌড়ে ছাদে চলে যায় অধরা,দুহাত দুইদিকে প্রসারিত করে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকে। দুরন্ত হাওয়া এসে বারবার অধরার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়,বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় অধরা। ভিতরে ভিতরে অন্যরকম একটা ভাললাগা কাজ করতে থাকে তার। জীবনটাকে অনেক রঙিন মনে হয় তার। কিছুক্ষণ পর মায়ের ডাক শুনে নিচে নেমে আসে অধরা। নিচে এসে অধরা দেখে টেবিলে নাস্তা রেডি আর তার বাবা অপেক্ষা করছে তার জন্য। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসে অধরা আর তারপর বাবা,মা,মেয়ে তিনজনে মিলে একসাথে সকালের নাস্তা করে। একমাত্র মেয়েকে খুব ভালোবাসেন মিস্টার সেন তাই শত ব্যাস্ততার মাঝেও মেয়েকে সময় দিতে তিনি কখনও ভুলেন না। সকালের নাস্তা আর রাতের খাবার সবসময় মেয়েকে সাথে নিয়েই করেন মিস্টার সেন।
মিসেস সেন ও কম ভালোবাসেন না মেয়েকে। অধরা তাই অনেক আদরের মাঝেই থাকে সবসময়। একমাত্র মেয়ে হিসেবে অধরার আহ্লাদ এর কোন শেষ নাই। মেয়ের প্রতিটি শখ আহ্লাদ পূরণ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন দুজনেই। সব মিলিয়ে তিনজনের ছিমছাম পরিবারটি সুখি একটি পরিবার। নাস্তা শেষ করে কলেজের জন্য ঝটপট করে রেডি হয় অধরা।
আজ কলেজে কালচারাল প্রোগ্রাম আছে সেখানে একটি একক নৃত্য পরিবেশন করবে অধরা আর তাই বেশ কিছুদিন ধরে অনেক প্র্যাকটিস করেছে সে,আজ কলেজে গিয়ে শেষ রিহার্সাল দিতে হবে। রিকশা করে রওনা দিল অধরা। রিকশায় ভ্রমন তার ভীষণ প্রিয় তাই মাঝে মাঝে ক্লাস শেষে কোন এক বান্ধবীকে নিয়ে বেরিয়ে পরে রিকশা ভ্রমনে। কলেজের সকালের ক্লাসটি করেই সোজা অডিটোরিয়ামে চলে যায় অধরা। দুপুর পর্যন্ত টানা রিহার্সাল করে,তারপর ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার শেষ করে বন্ধুরা মিলে জমপেশ আড্ডায় বসে অধরা। আড্ডার টপিক রিহার্সালে কে কোন ভুল করেছে, কে কি মজা করেছে আর কোন বড় ভাইয়া কোন জুনিয়রের সাথে টাংকি মেরেছে ইত্যাদি। বিকেল হতেই আড্ডা শেষ হয় ওদের। তারপর সবাই প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরে। প্রোগ্রাম শেষ হয় সন্ধ্যার একটু পরে।
সবাই যে যার ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে। সবার চোখেমুখে সফলভাবে প্রোগ্রাম শেষ করার খুশি। অধরার খুশিটা একটু বেশি কারণ সবাই তার নাচের অনেক প্রসংশা করেছে। নাচ নিয়ে অধরার অনেক স্বপ্ন। একদিন সে খুব বড় একজন নৃত্যশিল্পী হবে এটাই তার লক্ষ্য। ঘরে ফিরে এসেই অধরা তার মাকে নিয়ে গল্প করতে বসে যায়। আজ কি কি হয়েছে ভার্সিটিতে আর কে কি কমেন্ট করেছে তার নাচ সম্বন্ধে ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এটা অধরার প্রতিদিনের রুটিনে পরে গেছে। সারাদিন কি কি করেছে সেটা মাকে না বলা পর্যন্ত তার শান্তি হয় না। গল্প শেষ করে অধরা তার রুমে চলে যায় আর মিসেস সেন চলে যান রান্নঘরে।
সারাদিনের মেঘলা আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমে আসে। অধরার মনটা আজকে অনেক খুশি তাই হটাৎ করে মাথায় ভুত চাপে বৃষ্টিতে ভিজার। সাথে সাথে দৌড়ে ছাদে চলে যায় অধরা আর দুহাত বাড়িয়ে বৃষ্টিবিলাস করতে থাকে,মনে মনে ভাবতে থাকে জীবনটা অনেক রঙিন,অনেক স্বপ্নময়। সব মিলিয়ে অনেক ভালো আছে সে। জীবন থেকে যতটুকু পেয়েছে তাতেই সে অনেক খুশি এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নেই তার। বৃষ্টিবিলাস করতে করতে আনমনে অধরা তার প্রিয় গানটি গেয়ে উঠে,
“দেখেছ কি তাকে ঐ নীল নদীর ধারে,
বৃষ্টি পায়ে পায়ে,তার কি যেন কি নাই;
জলে ভেজা মাঠে আকাশে হাত বাড়ায়,
মেঘের আড়ালে ভেসে থাকা সেই রংধনুকে চায়।
ঝরাপাতা উড়ে তাকে ছুঁয়ে বলে যা,যারে
এখানে বড়ই ফিকে সব তুই যা;
তাই সে যায়,ছুটে বেড়ায়,ধূসর প্রান্তরে
মেঘের গায়ে হাত বুলায় রংধনুকে চায়”।
২.
অধরা, অধরা.....................অনবরত ডেকে চলেছেন মিসেস সেন। আচমকা আড়মোড়া ভেঙে উঠে পরে অধরা। তারপর অজানা এক অপরাধী ভঙ্গি নিয়ে কিছুক্ষণ মা’র দিকে তকিয়ে থাকে সে। মিসেস সেন মেয়ের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পারেন কোন এক সুন্দর স্বপ্ন দেখাতে ব্যাস্ত ছিল তার মেয়েটি। এটা তার কাছে নতুন কিছু না কারণ অধরা প্রায়ই স্বপ্ন দেখে আর ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করে। মিসেস সেন তখন মেয়েকে কোনভাবেই সান্ত্বনা দিতে পারেন না। তাই আজ সব বুঝেও না বুঝার ভান করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,তোমার বাবা অপেক্ষা করছেন তাড়াতাড়ি নাস্তার টেবিলে এসো।
যাওয়ার আগে খাটের পাশ থেকে স্ক্রেচ দুটো মেয়েকে এগিয়ে দেন মিসেস সেন। অধরার চোখদুটো তখন জলে ছলছল করছে। মেয়ের স্বপ্নে ভরা চোখদুটোর দিকে তাকানোর সাহস হয় না মিসেস সেনের। প্রতিটা দিন মেয়ের মুখের দিকে তাকালে নিজের অপরাধবোধটা বেড়ে যায় তার। ঠিক সময় যদি মেয়ের পোলিও টীকাটা দিতে পারতেন তাহলে হয়ত তার মেয়েও অন্যান্য মেয়েদের মত স্বাভাবিক হত,দৌড়ঝাঁপ করতে পারত।
প্রতিদিনের মত আফসোস করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যান তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পরে অধরা, তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে যায়। সবার সাথে নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে ফিরে আসে অধরা। ইদানিং অসুস্থতা একটু বেড়েছে তাই ঠিকমত কলেজে যেতে পারে না সে। সারাদিন গল্পের বই পড়ে, গান শুনে আর টিভি দেখে সময় কেটে যায় অধরার। নাচ অধরার খুব প্রিয় তাই টিভিতে কোন নাচের প্রোগ্রামই সে মিস করে না। মাঝে মাঝে বিকেলবেলা বন্ধুরা আসে তার সাথে দেখা করতে, আড্ডা মারতে মারতে তখন সময়টা মোটামুটি ভালোই কেটে যায় তার। আসলে মা-বাবার ভালবাসা আর সার্বক্ষণিক যত্ন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, গল্পের বই, গান শোনা আর নাচ নিয়ে খুব একটা খারাপ নেই অধরা।
তবুও মাঝে মাঝে যখন স্বপ্নগুলো চোখের সামনে এসে পরে তখন নিজেকে আর সামলাতে পারে না অধরা,তখন জীবনটা শুধুই ধূসর মনে হয় তার কাছে। স্বপ্নের গাড় রঙগুলো সামনের সবকিছুকে তখন ঝাপসা করে দেয়। আজও বিকেলবেলা তার কয়েকজন বন্ধু তাকে দেখতে আসলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশ জমপেশ একটা আড্ডা হয়ে গেল। বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছে, তাই সন্ধ্যে হতেই সবাই যে যার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা ভালো কাটে অধরার কিন্তু বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর হটাৎ একরাশ শুন্যতা এসে গ্রাস করে অধরাকে। বাইরে সারাদিনের মেঘলা আকাশ ভেঙ্গে একটু পরে বৃষ্টি নামে,অঝোর বৃষ্টি।
অধরার খুব ইচ্ছে করে ছাদে উঠে এই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে,বৃষ্টির জলে নিজের দুঃখগুলো ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে তার খুব কষ্ট হয় তাই ইচ্ছেটাকে মনের ভিতরেই কবর দেয় অধরা। রুমের বাতি নিভিয়ে দিয়ে,পিসি থেকে নিজের প্রিয় গানটা ছেড়ে জানালার পাশে এসে বসে অধরা। জানালার পাশে বসে একমনে বৃষ্টি দেখতে থাকে অধরা আর ভাবতে থাকে কবে তার অধরা স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে ধরা দিবে। জীবনটা তার কাছে অনেক ধূসর অনেক নিষ্প্রাণ মনে হয়। জীবনটা বোধয় এমনই,কিছু কিছু স্বপ্ন সারাজীবন অধরা থেকে যায়। জীবন থেকে মানুষ যতটা চাই ঠিক ততটাই পায় না। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে, বাঁচতে হবে বলেই হয়তো বেঁচে থাকে। দু-এক ফোঁটা অভিমানী বৃষ্টি অধরার দুচোখ বেয়ে নেমে আসে যার সাক্ষী হয়ে থাকে কাঠের জানালাটা, মেঘলা আকাশটা আর সারা ঘরময় বাজতে থাকা গানটা,
“দেখেছ কি তাকে ঐ নীল নদীর ধারে,
বৃষ্টি পায়ে পায়ে,তার কি যেন কি নাই;
জলে ভেজা মাঠে আকাশে হাত বাড়ায়,
মেঘের আড়ালে ভেসে থাকা সেই রংধনুকে চায়।
আনমনা মেঘ দূরে যায় কেন কে জানে?
কিছুতেই তার কাছে ধরা দেই না, না না;
তবুও তার মেঘে উড়ার অন্তহীন টানে,
ভিজে হাওয়ায় পাখিরা গায়,রংধনুকে চায়।
জানি একদিন মেঘের ঠিকানা সে পাবে,
বলবে পাখিরা ওরে মেঘ তুই গা, গা গা;
তোর কাছেই আসবে গান তোর কাছেই যাবে,
যারা হারায় রুপকথায় রংধনুকে চায়”।
লিখেছেন - সত্যজিৎ রায় |
: