বিশ্বটাকে বদলে দাও : ড্যানিয়েল সল গোল্ডিন

Post a Comment

ড্যানিয়েল সল গোল্ডিন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সাবেক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (১৯৯২-২০০১)। গোল্ডিনের তত্ত্বাবধানেই ১৯৯৭ সালে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণার মহাকাশযান ‘মার্স পাথফাইন্ডার’ যাত্রা শুরু করে। ১৯৪০ সালের ২৩ জুলাই নিউইয়র্কে তাঁর জন্ম। ২০০১ সালের ৮ জুন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য দেন।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আসতে পেরে আমি খুব গর্বিত। আগের বছরের (২০০০) ঠিক এই দিন ইতালির ইউনিভার্সিটি অব পাডুয়া আমাকে সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। সেখানেও আমি বক্তব্য দিয়েছিলাম। আমার প্রিয় মানুষ ও আদর্শ গ্যালিলিও গ্যালিলাই পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক ছিলেন। সেখানেই তিনি তাঁর প্রথম টেলিস্কোপটি বানিয়েছিলেন। সেই টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন মহাকাশের অনেক অজানা। পাডুয়াতেই তিনি সিডেরাস নানসিয়াস বইটি লিখেছিলেন। আমি আরও গর্বিত, কারণ পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘরে গ্যালিলিও তখনকার সর্বসেরা শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তব্য দিতেন, আমি সেই ঘরেই বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেদিন ওখানে যে পোশাকটা পরেছিলাম, আজ সেটাই পরে আছি। মূলত এ পোশাকটা ওখানকার ঐতিহ্য।
কিন্তু তোমরা হয়তো ভাবছ, কেন আমি এই পোশাকটা পরে আছি? আমি এটা পরেছি তোমাদের স্মৃতিতে একটা প্রতিচ্ছবি ফেলার জন্য। সামনে তোমাদের জীবনের গূঢ় রহস্য উন্মোচনের দিন। তোমরা হয়তো আমাকে মনে রাখবে না। কিন্তু এই টুপি ও কোটটা তোমাদের চোখে ভেসে থাকবে।
আর মনে পড়বে গ্যালিলিওকে, তাঁর জীবন ও আদর্শকে। আমৃত্যু জ্ঞানচর্চা ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। তিনি উৎকর্ষ সাধনে নিজেকে ব্রত করেছিলেন। তিনি শুধু সত্যের জন্য লড়াই করতেন তা-ই নয়, তিনি বিশ্বাস করতেন যে সত্যকে তিনি আবিষ্কার করতে পারবেন। গ্যালিলিওর মতো তোমরাও স্বাপ্নিক হও, সৃজনশীল ও সাহসী হও।
মনে রাখবে, ভয় নামের ঘোর কুয়াশা ও নিন্দুকের সমালোচনার আড়ালেই লুকিয়ে থাকতে পারে অজানা কোনো সত্য। এই সত্যকে জানতে হলে প্রাণে সাহস থাকা চাই। অবশ্যই নিজের ওপর আস্থা রাখতে হবে। অজানাকে জানার অদম্য ইচ্ছা ও কৌতূহল থাকতে হবে, লক্ষ্য হতে হবে অটুট।
দেখো, বিগত ৫০ বছরে বড় বড় অনেক অর্জন-আবিষ্কার আমরা করেছি। জেট বিমান থেকে মহাশূন্যে অভিযাত্রা, টিভি থেকে এমপিথ্রি, ইন্সট্যান্ট কফি থেকে তাৎক্ষণিক বার্তা প্রেরণ। এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন কেবল পৃথিবীকেই বদলে দেয়নি, বদলেছে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানকেও।
আরও যেসব অনাবিষ্কৃত সমস্যা আছে, তোমরাই পারো তার সমাধান বের করতে। অবশ্য সে জন্য তোমাদের প্রশ্ন করার অভ্যাস থাকতে হবে।
দেখো, আমরা এখনো আগের মতোই কম গতির বিমানে উড়ে বেড়াই। এখনকার কম্পিউটারগুলো শুধু গণনা করতে পারে, এগুলোর চিন্তাশক্তি বলে কিছু নেই। কিন্তু উৎকর্ষ সাধনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস ও সত্যানুসন্ধানের সাহস যাদের আছে, তোমাদের মেধা ও শ্রমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একদিন এসব সমস্যা উবে যাবে।
সেদিন কম্পিউটারগুলো কাজ করবে মানব-মস্তিষ্কের মতো। পাখি যেভাবে ওড়ে, বিমানগুলো সেদিন সেভাবেই আকাশে উড়ে বেড়াবে। প্রযুক্তি-ব্যবস্থা হবে স্বনিয়ন্ত্রিত। সিলিকন চিপভিত্তিক বর্তমান কম্পিউটারের খোঁজ সেদিন শুধু জাদুঘরেই মিলতে পারে, ঠিক ডাইনোসরদের পাশে।
যদি উৎকর্ষ সাধন ও সত্যানুসন্ধানই তোমার লক্ষ্য হয়, তবে তোমার স্বপ্ন আর গ্যালিলিওর স্বপ্ন একটাই। যেসব রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, একদিন তোমরাই তার আরোগ্য লাভের পথ দেখাবে। যে জীবনায়ু নিয়ে একজন মানুষ জন্ম নেয়, কমপক্ষে সেই সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকার পথটা পৃথিবীকে তোমরাই দেখাবে। বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার যে রদবদল, তার সঠিক সমাধানও তোমরাই বের করবে। আমাদের সৌরজগতের বাইরে, মহাকাশের নক্ষত্ররাজিতে একদিন তোমরা অভিযান চালাবে। তোমরা হয়তো আকাশপানে তাকিয়ে প্রশ্ন করবে, যে প্রশ্নটা আদিম মানুষেরাও করত, আমরা কি একা?
এসব স্বপ্ন দেখা কি উচ্চাভিলাষী? স্বপ্নগুলো কি আকাশ সমান বড় বা ঝুঁকিপূর্ণ? জেনে রেখো, নিশ্চিতভাবে নিন্দুকের সমালোচনার ফাঁদে তুমি পড়তে পারো। সন্দেহ নেই, বেশ কিছু বিপদ তোমার সামনে আসবে। কিন্তু ভুলে যেয়ো না, গ্যালিলিওকে তাঁর বিশ্বাসের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। মানুষ তাকে বিপথগামী ভেবেছিল। তোমরা ভয় পেয়ো না। জেগে ওঠো। মন থেকে ভয় ঝেড়ে ফেলো। সামনের দিকে এগিয়ে যাও।
জীবনে ব্যর্থ না হওয়াটা উৎকর্ষের উদাহরণ নয়। বরং ব্যর্থতা বলে দেয় যে তোমার স্বপ্নটা অসাধ্য কিছু নয়। কঠোর পরিশ্রম দিয়ে ব্যর্থতাকে তুমি জয় করতে পারো। ব্যর্থতা কোনো প্রতিবন্ধক হতে পারে না, যদি না তুমি একে এড়িয়ে যাও কিংবা ব্যর্থতা থেকে শিখতে না চাও।
সফল হওয়ার পর তুমি কীভাবে প্রতিক্রিয়া করো—তাতে তোমার চরিত্রের প্রকৃত রূপটা ফুটে উঠবে না। ব্যর্থ হওয়ার পর তুমি কী করো, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নিজেকে বিশ্বাস করো। শেখা, উৎকর্ষ সাধন ও সত্য প্রকাশে সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকো। এটাই ছিল গ্যালিলিওর শিক্ষা। এই শিক্ষাটা আমি আমার বাবার কাছ থেকেও পেয়েছি। এখানে দাঁড়িয়ে আছি—এটা দেখতে পেলে তিনি খুব গর্বিত হতেন। সম্ভবত তিনিও প্রশ্ন করতেন, ‘ড্যান, তোমার গায়ে এই পোশাক কেন?’ তবে তিনি খুশি হতেন নিশ্চয়।
ছয় বছর হলো বাবা মারা গেছেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় আমার বাবা কলেজ থেকে জীববিজ্ঞানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পরের বেশ কয়েক বছর তিনি কোনো চাকরি পাননি। তিনি ডাকঘরে কাজ করেছিলেন। অবশেষে অবশ্য শিক্ষক হয়েছিলেন তিনি, এ পেশাটাকে তিনি খুব পচ্ছন্দ করতেন।
জীবনভর শেখার আত্মপ্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর। তিনি সর্বদাই সত্য বলতেন। একইভাবে নিজের একমাত্র ছেলেকেও সে রকমই দেখতে চেয়েছিলেন তিনি।
সবাই বলে, তোমরা হলে ভবিষ্যৎ। আর আমি বলি, ভবিষ্যৎ এখনই। সুতরাং কল্পনাশক্তি ও উদ্ভাবনীশক্তি এবং দুঃসাহসিকতা দিয়ে অভিযান চালাও, আবিষ্কার করো, বিশ্বটাকে দাও বদলে।
ভালোবাসা ও কাজ—দুটোর জন্যই সময় রাখো। তোমরা ব্যস্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু কখনোই পরিবার ও বন্ধুদের ভুলে যেয়ো না।
আমি আগেও বলেছি, গ্যালিলিও যদি বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি এখানে শিক্ষকতা করতে চাইতেন। আরেক দিক থেকে গ্যালিলিও এখানে রয়েছেনু। প্রকৃতপক্ষে, আমার সামনে তোমরা দুই হাজার ৪০০ গ্যালিলিও বসে আছো, যারা আজ ডিগ্রি পাবে।
তোমরা কখনোই তোমাদের আবিষ্কারকে অমূলক মনে করবে না। জীবনভর জ্ঞানচর্চা করো। উত্তরোত্তর উৎকর্ষ সাধনে ব্রত হও। শুধু সত্যের সন্ধান করো না, নিজেকেও বিশ্বাস করো। তাহলেই তুমি সত্যকে খুঁজে পাবে।
অভিনন্দন সবাইকে। তোমাদের যাত্রা শুভ হোক।


Related Posts

: