রিনা রান্নঘরে। ডিম ভাজছে। রাতুল হাতমুখ ধুয়ে মুখ মুছতে মুছতে খাবার টেবিলে বসেছে মাত্র। টেবিলের উপরেই রিনার ফোনটা বেজে উঠল। রিনাকে দুইবার ডাকার পরও কোন সাড়া না পাওয়ায় নিজেই রিসিভ করলো রাতুল। হ্যালো বলার আগেই ওপাশের কথা শুরু হলো
-কি করছো সোনা? হ্যালো, হ্যালো…..
কেটে গেলো কলটা। রাতুলের নিরপেক্ষ মুডটা খারাপের দিকে মোড় নিল। এসব বিষয় কেউ না ভাবতে চাইলেও ভাবনাগুলো যেন জোর করে মাথায় ভর করতে চায়। খুব মেজাজ খারাপ আর বিরক্তি লাগছিল।
“এইতো তোমার ডিমভাজি, প্রতিদিন রাতে ডিমভাজি খাওয়া এইটা কেমন অভ্যাস ধরেছো, হ্যা? আর করতে পারবো না এসব বুচ্ছ! ভালোলাগে না” বিরক্তি নিয়ে অনর্গল বলে গেল রিনা।
-তোমার ফোনে কেউ কল করেছিল।
-কখন?
-এখনি , একটু আগে।
রিনার মুখে আতঙ্ক লুকানোর অভিনয় লক্ষ করতে পারলো রাতুল। রিনা হাসির ভান করে ভাত তুলে দিতে দিতে বলল
-কে? কি বলল?
-বলল যে “সোনা কি করছো?” অার কে বলল, সেটা তুমিই বল
-আ.. আ.. আমি কিভাবে বলব?!! আশ্চর্য!! আসে না কত রং নম্বর থেকে ফোন? তেমনই হবে হয়ত।
রাতুল এমনিতেই কিছু মনে করত না, কিন্তু রিনার ভঙ্গিতে কিছু মনে করতে বাধ্য করছে। তারপরেও রাতুল সবকিছু স্বাভাবিকই ধরে নিতে চাইল।
.
সকাল ১১ টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত ক্লাক্তিকর অফিস করে বাসায় ফেরে রাতুল ছুটিরদিনগুলো ছাড়া তাতে কি! তার ইনকাম মোটেই কম নয়। বিলাসবহুল জীবনযাপন করেও মোটা অঙ্কের সঞ্চয়ও রাখা যায় অনায়াসেই।শুধু সময় পাওয়া যায় না এটাই সমস্যা। যখনই সময় পাওয়া যায় তখনই রিনাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় রাতুল। নিজের যোগ্যতা্য় চাকরীটা পেয়েই রিনাকে বিয়ে করেছিল সে ২ বছর আগে। প্রেমের বিয়ে। ৩ বছরের প্রেম। সে এক অমায়িক প্রেম! ভার্সিটির সব কাপল-এর আইকনি ছিল রাতুল-রিনা। যেমন তাদের মানায় তেমনি তাদের আনডারস্ট্যান্ডি
ং। যেন একজন শুধুমাত্র অারেকজনের জন্যই।
.
অফিসের কাজ করতে করতে হঠাৎ কাল রাতের ফোনের কথাটা মনে পড়ে গেলো রাতুলের। অনেকটা ভুলেই গিয়েছিল সে। এই ভাবনাগুলোর মাথাচাড়া দেওয়ার ক্ষমতা প্রবল।আচ্ছা রিনা সত্যি সত্যি কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পরছে না তো? যদি এমনই হয় তাহলে কি হবে তার ভালোবাসার? কি হবে রাতুলের ভবিষ্যৎ? এত গভীর ভালোবাসা ছেড়ে কি রিনা চলে যেতে পারে অন্য কারো হাত ধরে?! উফফ, কি সব ওলট পালট ভাবনা, রিনা মোটেও সেরকম নয়। তাকে রাতুল ভালোভাবেই চেনে। রিনা যে রাতুলকে খুব খুব ভালোবসে তা রাতুল ভালোভাবেই জানে। সে কখনোই রাতুলকে ছেড়ে যেতে পারে না। এসব ভেবেই নিজেকে ঠিক রাখতে চায় রাতুল।
.
রিনা রান্নাঘরে, আজও রাতুল হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসলো। আজ রিনার ফোনটা টেবিলের উপর নেই। ফোনটা যে রিনার হাতে তা ফোনের শব্দ শুনে বুঝতে পারলো রাতুল। রিনা ফোনটা কেটে দিল তাও স্পষ্ট বুঝা গেলো। রাতুল আর নিজেকে ঠিক রাখতে চাইলো না। তাকে ব্যাপারটা বুঝতেই হবে।
.
রাতুলের চোখে আজ ঘুম নেই। সে খেয়ালও করলো যে রিনার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। এইতো কয়েকদিন আগে পর্যন্ত রাতে শোয়ার পর রাতুলের বুকে মাথা রেখে কত আবেগ নিয়ে সারাদিনের ঘরোয়া কিউট কিউট কাজগুলোর কথা কি সুন্দর করে শুনাতো রিনা। কতবার রাতুলকে মিস করেছে সেটাও গুনে রাখতো রিনা। এসব শুনে মন ভরে উঠত রাতুলের। সে আরো শক্ত করে রিনাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস ফেলতো চোখ বন্ধ করে।
এখন আর তা হয় না। রাতুল তাতে অন্যকিছু ভাবে নি, কিন্তু এখন ঘটনাগুলো তাকে অনেক কিছুই ভাবাচ্ছে।
রিনা ঘুমিয়ে পরেছে। রাতুল বালিশের কাছে থেকে রিনার ফোনটা হাতে নিল । অনেকদিন হলো হাতে নেওয়া হয় নি ফোনটা। কল লিষ্টটা একদম ফাকা, ব্যাপারটা স্বভাবিক নয়। ইনবক্সে গিয়ে আটকে গেলো রাতুল ।
ছেলেটার নাম আকাশ। আকাশ আর রিনার কিভাবে পরিচয় হলো তা বুঝা যাচ্ছে না মেসেজগুলো দেখে। আগের অনেক মেসেজই ডিলিট করা হয়েছে। রাতুল সবগুলো মেসেজ পড়তে থাকলো। গত কয়েকদিনে ৩/৪ বার দেখা করেছে ওরা। এই দেখা করাতে দুজন দুজনের প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পরেছে। রাতুল সবচেয়ে অবাক হলো সেই মেসেজটা দেখে যেখানে রিনা আকাশকে বাসায় আসতে বলছে যখন রাতুল অফিসে থাকে। কিন্তু আকাশ বাসায় আসতে চায় না। সে চায় রিনা যেনো সবকিছু ছেড়ে তার কাছে চলে যায়। সে একেবারেই নিজের করে পেতে চায় রিনাকে।
আর পড়তে পারছে না রাতুল। বুকের মধ্যে কি যেন জমা হলো। ফেনটা রেখে পাশ ফিরে রিনার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মখটার দিকে তাকালো রাতুল। ডিম-লাইটের আলোতে কি মায়াবি লাগছে চেহারাটা! এটা সেই রিনা যাকে বুক ভরে ভালোবেসেছিল রাতুল।এখনো ভালোবাসে। যার জন্য যে কোন কিছু করতে পারে সে। মায়াবি মুখটার উপর কয়েকটা চুল খেলা করছিল, খুব সন্তর্পণে আঙুল দিয়ে সেগুলো সরে দিতেই চোখ ভেঙে পানি আসলো রাতুলের। মায়াবী মুখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তবুও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এই ভালোবাসা ভরা মুখটা থেকে কি চোখ সরানো সম্ভব!
.
-কি ব্যাপার আজ অফিসে গেলে না?
-ছুটি নিয়েছি। ভালো করি নি?
-ওও আচ্ছা, হ্যা ভালো করেছো।
-চলো ঘুরে আসি আজ দূরে কোথাও। কত সুন্দর মেঘলা দিন আজ!
আগের মত খুশিটা রিনার মধ্যে লক্ষ করা গেলো না। খুশি হওয়ার ভান করেই সে বলল ,
-হ্যা চলো।
.
এই জায়গাটাতে রাতুল অার রিনার প্রথম ভালোবাসার সাক্ষাৎ হয়েছিল এতদিনে আসা হয়নি আর। আজ রিনাকে এখানেই নিয়ে এসেছে রাতুল। পাশেই নদী, প্রচুর বাতাস, তার-উপর আজ রোদ্ও নেই। একটা সুন্দর দাড়ানোর জায়গা। রিনার খোলা চূলগুলো যেন আনন্দের সাগরে সাতার কাটছে। কিন্তু রিনার মুখে মেকি আনন্দের ছাপ।
-তুমি কি ভালো আছো রিনা?
-কেন? দেখতেই তো পাচ্ছ.. তোমার সাথে ঘুরতে এসেছি তাও আবার এমন একটি জায়গায় , ভালো থাকবো না?
-ভালোবাসো?
-অনেক ভালোবাসি...
অকপটেই উত্তর দিল রিনা।
-অাকাশকে?
ভীতি আর বিষ্ময় নিয়ে আটকা আটকা গলায় রিনা বললো
-আকাশ? আকাশ কে?
-যা আমি জানি তা কেন অযথা লুকোনোর চেষ্টা করছো রিনা? কি লাভ তাতে?
এসব বলতেই রিনার সামনেই রাতুলের চোখ ভরে উঠলো। রিনা আর কিছু বলতে পারলো না। সে মাথা নিচু করে থাকলো।
-রিনা আমার দোষটা কি বলতো? কি দোষ আমার? আমি তোমাকে ভালোবাসি রিনা। তুমি আমার ভালোবাসাকে এইভাবে অপমান করলে? এইভাবে? কিভাবে পারলে তুমি রিনা?
যে চোখের পানি মুছলে আবার পানি আসবেই সে পানি মুছে কি লাভ! তাই চোখের পানিগুলো চেহারা বয়েই নামতে থাকলো রাতুলের। রীনা পাথর হয়ে আছে।
-এই জায়গাতে দাড়িয়েই তুমি আমার হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলে ভুলে গেছো? তুমি বলেছিলে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না কখোনোই, মনে পড়ে রিনা?
কথাগুলো বলতে বলতে অনেকবার আটকে গিয়েছিল রাতুল, তার কান্না তাকে আটকিয়েছে। রাতুলের কান্নায় রিনাও পারল নি নিজেকে ঠিক রাখতে । রিনাও ছেড়ে দিয়েছে চোখের পানি।
রাতুল এগিয়ে এসে রিনার হাতগুলো ধরলো,
-কাদছো কেন তুমি ? তুমি ভেবো না আমি তোমাকে এখন ভালোবাসি না রিনা। তুমি আমার কাছে সবসময়িই তেমনই, যেমন ছিলে। যা হবার হয়ে গেছে রিনা, প্লিজ তুম ফিরে আসো। প্লিজ রিনা।
রিনা তার কা্ন্নাকে আর সামাল দিতে পারলো না্। রাতুলের বুকে মাথা গুজে সে শব্দ করে কেদে উঠল। দুজনের সেই মিলন দৃশ্যটা মনে হয় শুধু পাশে বয়ে চলা নদীটা্ই দেখে হেসেছিল। হয়তো মেঘগুলোও দূর থেকে দেখছিল তাদের ।
.
আজ অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিল । বাসায় ফিরে রিনাকে দেখবে রাতুল এ্টাই কেন জানি খুব আনন্দের বিষয় মনে হচ্ছে আজ। রিনা তার ভুল বুঝতে পেরেছে, সে কখনোই এমন ভুল আর করবেনা কাল রাতে এ কথাই বলেছে রিনা। কাজের চাপ বেশী থাকলেও তা আজ ক্লান্ত করতে পারেনি রাতুলকে। রাতুল বাড়িতে যাওয়ার আগে মার্কেট থেকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ী কিনে নিল, ঠিক যেন বিয়ের শাড়ী। রিনা খুব খুশি হবে।
.
ঘরে ঢুকে ব্রিফকেসটা রাখতে রাখতে রাতুল রিনাকে ডাকছে।
-দেখোতো শাড়ীটা কেমন,, কই গেলে ,, রিনা...
কি ব্যাপার! কোন ঘরেই রিনা নেই। দরজাটাও তো খোলা ছিল। বাসার নিচে দাড়োয়ানের কাছে চলে গেলে রাতুল।
-তোমার ম্যাডাম কই?
-স্যার উনি তে বাইরে গেছেন সেই দুপুরে। দুই হাতে দু্টা বড় বড় ব্যাগ ছিল ।
-কিছু বলে গেছে?
-জ্বী স্যার। ম্যাডাম বললো যে উনি আকাশ নামে কারো কাছে যাচ্ছে। অার আপনি যেন তাকে না খোজেন।
মাথা নিচু করে লজ্জা নিয়ে আটকে আটকে বললো দাড়োয়ান । রাতুলও কম লজ্জিত হলো না।
রিনার সব নম্বরে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলো, সব বন্ধ।
আর কিছু বাকি থাকলো না বুঝার। সব পরিস্কার।
.
ঘরে গিয়ে নিঃশ্ব মানুষের মত শুয়ে পড়লো রাতুল। আজ তার চোখে পানি নেই। শুয়ে শুয়েই কাকে যেন ফোন দিল ।
হ্যালো আকাশ
হ্যা রাতুল।
এক্ষুণি বাসায় আসেন।
.
রাতুল ৫০০০০ টাকা তুলে দিল আকাশের হাতে। আকাশ একজন সাইকোলজিস্ট। রাতুলই তাকে খুজে বের করেছিল। আকাশের সাথে রাতুলের ডিল হয়েছিল এরকম, যদি রিনাকে সে রাতুলের থেকে আলাদা করতে পারে এমনভাবে যাতে রিনা বুঝতেই না পারে যে রাতুল তাকে আলাদা করতে চায়, অর্থ্যাৎ রিনা নিজের ইচ্ছায় চলে যায় তাহলে আকাশ ৫০০০০টাকা পাবে। আকাশ সহজভাবেই ডিলটি গ্রহণ করেছিল, বলেছিল এটা তার কাছে কোন ঘটনাই নয়। কারণ সাইকোলজিস্ট হিসেবে সে জানে যে কি পেলে মানুষ কি ছাড়তে রাজি হয়, সে জানে মানুষ কেনো কোন আচরণ করে। সে জানে কিভাবে মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে হয়।
আজ রাতেই আকাশ কানাডা চলে যাবে।রিনাকে কোথায় রেখে যাবে তা জানার প্রয়োজনও বোধ করলো না রাতুল।
.
আকাশ বাসা থেকে চলে যাওয়ার পরপরই রাতুল তার ফোনটা হাতে তুলে নিল।
-হ্যালো নাদিয়া
-কি খবর রাতুল
-এখন আর তোমার আমার মধ্যে কোন বাধা নেই নাদিয়া।
-সত্যি , এসব তুমি কিভাবে করলে রাতুল ?!
-যা-হোক বাদ দাও। তোমার জন্য বিয়ের শাড়ী আমি কিনে ফেলেছি, চলো অামরা শুভ কাজটা পরশুদিনই সেরে ফেলি।
-লাভ ইউ রাতুল , দাড়াও আমার ফ্রেন্ডদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করি।
-কি করছো সোনা? হ্যালো, হ্যালো…..
কেটে গেলো কলটা। রাতুলের নিরপেক্ষ মুডটা খারাপের দিকে মোড় নিল। এসব বিষয় কেউ না ভাবতে চাইলেও ভাবনাগুলো যেন জোর করে মাথায় ভর করতে চায়। খুব মেজাজ খারাপ আর বিরক্তি লাগছিল।
“এইতো তোমার ডিমভাজি, প্রতিদিন রাতে ডিমভাজি খাওয়া এইটা কেমন অভ্যাস ধরেছো, হ্যা? আর করতে পারবো না এসব বুচ্ছ! ভালোলাগে না” বিরক্তি নিয়ে অনর্গল বলে গেল রিনা।
-তোমার ফোনে কেউ কল করেছিল।
-কখন?
-এখনি , একটু আগে।
রিনার মুখে আতঙ্ক লুকানোর অভিনয় লক্ষ করতে পারলো রাতুল। রিনা হাসির ভান করে ভাত তুলে দিতে দিতে বলল
-কে? কি বলল?
-বলল যে “সোনা কি করছো?” অার কে বলল, সেটা তুমিই বল
-আ.. আ.. আমি কিভাবে বলব?!! আশ্চর্য!! আসে না কত রং নম্বর থেকে ফোন? তেমনই হবে হয়ত।
রাতুল এমনিতেই কিছু মনে করত না, কিন্তু রিনার ভঙ্গিতে কিছু মনে করতে বাধ্য করছে। তারপরেও রাতুল সবকিছু স্বাভাবিকই ধরে নিতে চাইল।
.
সকাল ১১ টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত ক্লাক্তিকর অফিস করে বাসায় ফেরে রাতুল ছুটিরদিনগুলো ছাড়া তাতে কি! তার ইনকাম মোটেই কম নয়। বিলাসবহুল জীবনযাপন করেও মোটা অঙ্কের সঞ্চয়ও রাখা যায় অনায়াসেই।শুধু সময় পাওয়া যায় না এটাই সমস্যা। যখনই সময় পাওয়া যায় তখনই রিনাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় রাতুল। নিজের যোগ্যতা্য় চাকরীটা পেয়েই রিনাকে বিয়ে করেছিল সে ২ বছর আগে। প্রেমের বিয়ে। ৩ বছরের প্রেম। সে এক অমায়িক প্রেম! ভার্সিটির সব কাপল-এর আইকনি ছিল রাতুল-রিনা। যেমন তাদের মানায় তেমনি তাদের আনডারস্ট্যান্ডি
.
অফিসের কাজ করতে করতে হঠাৎ কাল রাতের ফোনের কথাটা মনে পড়ে গেলো রাতুলের। অনেকটা ভুলেই গিয়েছিল সে। এই ভাবনাগুলোর মাথাচাড়া দেওয়ার ক্ষমতা প্রবল।আচ্ছা রিনা সত্যি সত্যি কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পরছে না তো? যদি এমনই হয় তাহলে কি হবে তার ভালোবাসার? কি হবে রাতুলের ভবিষ্যৎ? এত গভীর ভালোবাসা ছেড়ে কি রিনা চলে যেতে পারে অন্য কারো হাত ধরে?! উফফ, কি সব ওলট পালট ভাবনা, রিনা মোটেও সেরকম নয়। তাকে রাতুল ভালোভাবেই চেনে। রিনা যে রাতুলকে খুব খুব ভালোবসে তা রাতুল ভালোভাবেই জানে। সে কখনোই রাতুলকে ছেড়ে যেতে পারে না। এসব ভেবেই নিজেকে ঠিক রাখতে চায় রাতুল।
.
রিনা রান্নাঘরে, আজও রাতুল হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসলো। আজ রিনার ফোনটা টেবিলের উপর নেই। ফোনটা যে রিনার হাতে তা ফোনের শব্দ শুনে বুঝতে পারলো রাতুল। রিনা ফোনটা কেটে দিল তাও স্পষ্ট বুঝা গেলো। রাতুল আর নিজেকে ঠিক রাখতে চাইলো না। তাকে ব্যাপারটা বুঝতেই হবে।
.
রাতুলের চোখে আজ ঘুম নেই। সে খেয়ালও করলো যে রিনার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। এইতো কয়েকদিন আগে পর্যন্ত রাতে শোয়ার পর রাতুলের বুকে মাথা রেখে কত আবেগ নিয়ে সারাদিনের ঘরোয়া কিউট কিউট কাজগুলোর কথা কি সুন্দর করে শুনাতো রিনা। কতবার রাতুলকে মিস করেছে সেটাও গুনে রাখতো রিনা। এসব শুনে মন ভরে উঠত রাতুলের। সে আরো শক্ত করে রিনাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস ফেলতো চোখ বন্ধ করে।
এখন আর তা হয় না। রাতুল তাতে অন্যকিছু ভাবে নি, কিন্তু এখন ঘটনাগুলো তাকে অনেক কিছুই ভাবাচ্ছে।
রিনা ঘুমিয়ে পরেছে। রাতুল বালিশের কাছে থেকে রিনার ফোনটা হাতে নিল । অনেকদিন হলো হাতে নেওয়া হয় নি ফোনটা। কল লিষ্টটা একদম ফাকা, ব্যাপারটা স্বভাবিক নয়। ইনবক্সে গিয়ে আটকে গেলো রাতুল ।
ছেলেটার নাম আকাশ। আকাশ আর রিনার কিভাবে পরিচয় হলো তা বুঝা যাচ্ছে না মেসেজগুলো দেখে। আগের অনেক মেসেজই ডিলিট করা হয়েছে। রাতুল সবগুলো মেসেজ পড়তে থাকলো। গত কয়েকদিনে ৩/৪ বার দেখা করেছে ওরা। এই দেখা করাতে দুজন দুজনের প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পরেছে। রাতুল সবচেয়ে অবাক হলো সেই মেসেজটা দেখে যেখানে রিনা আকাশকে বাসায় আসতে বলছে যখন রাতুল অফিসে থাকে। কিন্তু আকাশ বাসায় আসতে চায় না। সে চায় রিনা যেনো সবকিছু ছেড়ে তার কাছে চলে যায়। সে একেবারেই নিজের করে পেতে চায় রিনাকে।
আর পড়তে পারছে না রাতুল। বুকের মধ্যে কি যেন জমা হলো। ফেনটা রেখে পাশ ফিরে রিনার নিষ্পাপ ঘুমন্ত মখটার দিকে তাকালো রাতুল। ডিম-লাইটের আলোতে কি মায়াবি লাগছে চেহারাটা! এটা সেই রিনা যাকে বুক ভরে ভালোবেসেছিল রাতুল।এখনো ভালোবাসে। যার জন্য যে কোন কিছু করতে পারে সে। মায়াবি মুখটার উপর কয়েকটা চুল খেলা করছিল, খুব সন্তর্পণে আঙুল দিয়ে সেগুলো সরে দিতেই চোখ ভেঙে পানি আসলো রাতুলের। মায়াবী মুখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তবুও তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এই ভালোবাসা ভরা মুখটা থেকে কি চোখ সরানো সম্ভব!
.
-কি ব্যাপার আজ অফিসে গেলে না?
-ছুটি নিয়েছি। ভালো করি নি?
-ওও আচ্ছা, হ্যা ভালো করেছো।
-চলো ঘুরে আসি আজ দূরে কোথাও। কত সুন্দর মেঘলা দিন আজ!
আগের মত খুশিটা রিনার মধ্যে লক্ষ করা গেলো না। খুশি হওয়ার ভান করেই সে বলল ,
-হ্যা চলো।
.
এই জায়গাটাতে রাতুল অার রিনার প্রথম ভালোবাসার সাক্ষাৎ হয়েছিল এতদিনে আসা হয়নি আর। আজ রিনাকে এখানেই নিয়ে এসেছে রাতুল। পাশেই নদী, প্রচুর বাতাস, তার-উপর আজ রোদ্ও নেই। একটা সুন্দর দাড়ানোর জায়গা। রিনার খোলা চূলগুলো যেন আনন্দের সাগরে সাতার কাটছে। কিন্তু রিনার মুখে মেকি আনন্দের ছাপ।
-তুমি কি ভালো আছো রিনা?
-কেন? দেখতেই তো পাচ্ছ.. তোমার সাথে ঘুরতে এসেছি তাও আবার এমন একটি জায়গায় , ভালো থাকবো না?
-ভালোবাসো?
-অনেক ভালোবাসি...
অকপটেই উত্তর দিল রিনা।
-অাকাশকে?
ভীতি আর বিষ্ময় নিয়ে আটকা আটকা গলায় রিনা বললো
-আকাশ? আকাশ কে?
-যা আমি জানি তা কেন অযথা লুকোনোর চেষ্টা করছো রিনা? কি লাভ তাতে?
এসব বলতেই রিনার সামনেই রাতুলের চোখ ভরে উঠলো। রিনা আর কিছু বলতে পারলো না। সে মাথা নিচু করে থাকলো।
-রিনা আমার দোষটা কি বলতো? কি দোষ আমার? আমি তোমাকে ভালোবাসি রিনা। তুমি আমার ভালোবাসাকে এইভাবে অপমান করলে? এইভাবে? কিভাবে পারলে তুমি রিনা?
যে চোখের পানি মুছলে আবার পানি আসবেই সে পানি মুছে কি লাভ! তাই চোখের পানিগুলো চেহারা বয়েই নামতে থাকলো রাতুলের। রীনা পাথর হয়ে আছে।
-এই জায়গাতে দাড়িয়েই তুমি আমার হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলে ভুলে গেছো? তুমি বলেছিলে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না কখোনোই, মনে পড়ে রিনা?
কথাগুলো বলতে বলতে অনেকবার আটকে গিয়েছিল রাতুল, তার কান্না তাকে আটকিয়েছে। রাতুলের কান্নায় রিনাও পারল নি নিজেকে ঠিক রাখতে । রিনাও ছেড়ে দিয়েছে চোখের পানি।
রাতুল এগিয়ে এসে রিনার হাতগুলো ধরলো,
-কাদছো কেন তুমি ? তুমি ভেবো না আমি তোমাকে এখন ভালোবাসি না রিনা। তুমি আমার কাছে সবসময়িই তেমনই, যেমন ছিলে। যা হবার হয়ে গেছে রিনা, প্লিজ তুম ফিরে আসো। প্লিজ রিনা।
রিনা তার কা্ন্নাকে আর সামাল দিতে পারলো না্। রাতুলের বুকে মাথা গুজে সে শব্দ করে কেদে উঠল। দুজনের সেই মিলন দৃশ্যটা মনে হয় শুধু পাশে বয়ে চলা নদীটা্ই দেখে হেসেছিল। হয়তো মেঘগুলোও দূর থেকে দেখছিল তাদের ।
.
আজ অফিসে অনেক কাজের চাপ ছিল । বাসায় ফিরে রিনাকে দেখবে রাতুল এ্টাই কেন জানি খুব আনন্দের বিষয় মনে হচ্ছে আজ। রিনা তার ভুল বুঝতে পেরেছে, সে কখনোই এমন ভুল আর করবেনা কাল রাতে এ কথাই বলেছে রিনা। কাজের চাপ বেশী থাকলেও তা আজ ক্লান্ত করতে পারেনি রাতুলকে। রাতুল বাড়িতে যাওয়ার আগে মার্কেট থেকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ী কিনে নিল, ঠিক যেন বিয়ের শাড়ী। রিনা খুব খুশি হবে।
.
ঘরে ঢুকে ব্রিফকেসটা রাখতে রাখতে রাতুল রিনাকে ডাকছে।
-দেখোতো শাড়ীটা কেমন,, কই গেলে ,, রিনা...
কি ব্যাপার! কোন ঘরেই রিনা নেই। দরজাটাও তো খোলা ছিল। বাসার নিচে দাড়োয়ানের কাছে চলে গেলে রাতুল।
-তোমার ম্যাডাম কই?
-স্যার উনি তে বাইরে গেছেন সেই দুপুরে। দুই হাতে দু্টা বড় বড় ব্যাগ ছিল ।
-কিছু বলে গেছে?
-জ্বী স্যার। ম্যাডাম বললো যে উনি আকাশ নামে কারো কাছে যাচ্ছে। অার আপনি যেন তাকে না খোজেন।
মাথা নিচু করে লজ্জা নিয়ে আটকে আটকে বললো দাড়োয়ান । রাতুলও কম লজ্জিত হলো না।
রিনার সব নম্বরে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলো, সব বন্ধ।
আর কিছু বাকি থাকলো না বুঝার। সব পরিস্কার।
.
ঘরে গিয়ে নিঃশ্ব মানুষের মত শুয়ে পড়লো রাতুল। আজ তার চোখে পানি নেই। শুয়ে শুয়েই কাকে যেন ফোন দিল ।
হ্যালো আকাশ
হ্যা রাতুল।
এক্ষুণি বাসায় আসেন।
.
রাতুল ৫০০০০ টাকা তুলে দিল আকাশের হাতে। আকাশ একজন সাইকোলজিস্ট। রাতুলই তাকে খুজে বের করেছিল। আকাশের সাথে রাতুলের ডিল হয়েছিল এরকম, যদি রিনাকে সে রাতুলের থেকে আলাদা করতে পারে এমনভাবে যাতে রিনা বুঝতেই না পারে যে রাতুল তাকে আলাদা করতে চায়, অর্থ্যাৎ রিনা নিজের ইচ্ছায় চলে যায় তাহলে আকাশ ৫০০০০টাকা পাবে। আকাশ সহজভাবেই ডিলটি গ্রহণ করেছিল, বলেছিল এটা তার কাছে কোন ঘটনাই নয়। কারণ সাইকোলজিস্ট হিসেবে সে জানে যে কি পেলে মানুষ কি ছাড়তে রাজি হয়, সে জানে মানুষ কেনো কোন আচরণ করে। সে জানে কিভাবে মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে হয়।
আজ রাতেই আকাশ কানাডা চলে যাবে।রিনাকে কোথায় রেখে যাবে তা জানার প্রয়োজনও বোধ করলো না রাতুল।
.
আকাশ বাসা থেকে চলে যাওয়ার পরপরই রাতুল তার ফোনটা হাতে তুলে নিল।
-হ্যালো নাদিয়া
-কি খবর রাতুল
-এখন আর তোমার আমার মধ্যে কোন বাধা নেই নাদিয়া।
-সত্যি , এসব তুমি কিভাবে করলে রাতুল ?!
-যা-হোক বাদ দাও। তোমার জন্য বিয়ের শাড়ী আমি কিনে ফেলেছি, চলো অামরা শুভ কাজটা পরশুদিনই সেরে ফেলি।
-লাভ ইউ রাতুল , দাড়াও আমার ফ্রেন্ডদের দাওয়াত দেওয়া শুরু করি।
: