বুনো

Post a Comment
love story, valobashar golpo, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প
আমি ঋভুকে শেষ যেদিন ফোন দেই তখন বাজে সাড়ে দশটা। ও সেলুনে ছিল।চুল কাটাচ্ছিল।আমি অস্থির হয়ে বেশ কয়েকবার ফোন দেই।ও বারবার ফোন কেটে দিচ্ছিলো।আমি ওকে বলতে চাচ্ছিলাম আমাকে আধাঘণ্টা সময় দেয়ার জন্য।ঋভুর সবার জন্যই সময় ছিল, শুধু আমার জন্যই ছিল না।ঋভুর পাশে সবাই থাকতে পারতো। আমি পারতাম না।ঋভুও চাইতো না,ওর ফ্রেন্ড সার্কেলও চাইতো না।আর ওর গা'ল ফ্রেন্ড তো আমাকে সহ্যই করতে পারতো না।তাই আমি সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললাম।ঋভুর থেকে দূরে চলে যাব।যত কষ্টই হোক।ওকে আর ফোন বা টেক্সট করবো না।এগারোই ফাল্গুন দশটা তেতাল্লিশ মিনিটে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর আমার মন ভেঙে কয়েকটুকরো হয়ে গেল। ওকে একটা টেক্সট করে দিলাম 'ঋভু, আমার আক্কেল নেইরে।আমি তো ফুটপাতের মেয়ে।যদি পারিস কাল আমাকে আধাঘণ্টা সময় দিস। গুড নাইট।'
তারপর আমি আমার ইনহেলারটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।কিচ্ছু করবো না। খাবো না।ওষুধ খাবো না।কিচ্ছু করবো না। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম জানি না।পরের দিন সাড়ে নটায় পাসপোর্ট অফিসে যাওয়া ছিল।ঘুম ভাঙতে দেখি নটা দশ বাজে।কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে ঝেড়ে দৌড় দিলাম।সারাদিন মন উৎকণ্ঠিত হয়ে রইলো এই বুঝি ঋভু ফোন দিল। নাহ, দেয়নি।সাড়ে তিনটায় ফাঁকা পেয়ে ওকে ফোন দিলাম।ও বলে দিল দেখা করতে পারবে না। ওর নাকি মাসল পেইন। ওর গা'লফ্রেন্ড কান্না করছে।বলেই ফোন অফ করে দিল।আমি টেক্সট করলাম।'আমাকে তুই আর খুঁজিস না ঋভু '।আমার অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।আমি ফোন রেখে দিলাম।সাথে সারাজীবনের জন্য ঋভুর লাইফ থেকে সরে দাঁড়ালাম। 
.
-হেই অনিন্ডিটা
মনে মনে ক্রিস্টিনাকে খাঁটি বাংলা ভাষায় বাছা কয়েকটা গালি দিলাম আমার সুন্দর নামের বিদঘুটে উচ্চারণের জন্য।হাসিমুখে বললাম,
-হাই ক্রিস্টিনা
-উইল ইউ গো টু হারিদ্বার?
-নোপ ক্রিস্টি।আই'য়াম নট ইন্টারেসটেড আবাউট এনি হলি প্লেস অর পারসন এন্ড অলসো এবাউট এনি রিলিজিওন।
-ওহ! আ ইউ আ আথেইস্ট?
-নোপ!
-সো হোয়াই ইউ ওন্ট গৌ?
-বিকজ
-জাস্ট বিকজ?
-ইয়া
-ইয়োর উইশ
ক্রিস্টিনা জোর করলো না।ক্রিস্টিনা যাওয়ার পর পরই বুনো এসে হাজির।
-অনি
-বল
-চল ঘুরে আসি
-কোথায়?
-দীঘা
-ঝাউবন আর ঘোলা পানি দেখে লাভটা কি?
-সমুদ্রতো
আমি দুমুহূর্তের জন্য চুপ করে গেলাম। তারপর বললাম,
-সমুদ্র দেখার কি আছে?
এবার বুনো কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
-তুই আসলে এত বছরেও ঋভুকে ভুলতে পারিস নি।তাই না?
.
বুনোর কথা শুনে আমি চুপ করে রইলাম।দেশ ছেড়েছি ছয়বছর হয়ে গেছে।দেশে যাইনি।দেশের কারো সাথে যোগাযোগ রাখিনি।সেই দিনের পর ঋভুর ফোন ধরিনি।ওর সামনে পড়লেও না দেখার ভান করে চলে গেছি।রুমে এসে হাউমাউ করে কাঁদতাম শুধু।আমি নিজের উপর যতটুকু অনিয়ম করা যেত করতাম।আমার শরীর ভেঙে গেছিলো পুরো। বারো সালের নভেম্বরে আমি দেশ ছাড়ি।আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য এয়ারপোর্টে কেউ ছিল না। আমার বিদায়ে কেউ দুফোঁটা চোখের পানি ফেলেনি।দেশের প্রতি, ঋভুর প্রতি বুকভরা অভিমান নিয়ে আমি দেশ ছেড়েছিলাম।
-অনি, কই হারালি?
বুনোর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
-কই?
-আচ্ছা অনি। যেই ছেলে তোকে কখনো ভালই বাসে নি।যার কাছে তোর কোনো মূল্যই ছিল না।যে তোর ইমোশনকে বলতো সস্তা।তাকে তুই এই ছয়বছরেও ভুললি না? কী আছে ওর মধ্যে?
-
-বল?
-
-কি হলো?
আমি বুনোর ডান হাতটা আমার বুকের উপর রেখে বললাম,
-হার্টবিট পাচ্ছিস?
-খুব লো
-এটা দিয়ে ভালবেসেছিলাম।তাই ভুলিনি।ভালবাসলে ভোলা অন্যায়।ভালবাসার শাস্তি হলো তাকে ভোলা যাবে না।চাওতো মরে যাও।ভুললেই পাপ।
বুনো হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
.
-অনি
- ভ্যাজরভ্যাজর না করে বল।
-'তবে ভাল ক্যান বাসিলা, স্বপ্ন ক্যান দেখাইলা, ভাল ক্যান বাসিলা আমারে '?
-আমি তোরে ভাল বাসবো ক্যা.....আরেহ! এই লাইন গুলা তুই কই
পাইলি রে বুনো?
- হু হু। কেন কেন?
-এইটা হাসানের বিখ্যাত একটা গান।আমার ছোটবেলায় ধুমায়ে চলতো।কিন্তু তুই এই গান পাইলি কিভাবে ইন্ডিয়ান মাংকি?
- ' আমি বারো মাস তোমায় ভালবাসি, তুমি অবসর পাইলে বাসিও। '
- সর্বনাশ! হাসান। তারপর এল.আর.বি.। ঝুলিতে আর কি রেখেছো বস?
-'কান্নায় লাভ নেই, কান্নায় হবে না,কোনদিন পদ্মা-মেঘনা, দিনের আলোয়, শুকিয়ে যাবে সে, হবেনাতো এক নদী
যমুনা '।
-ইয়াল্লা! গুরু!
- 'ন না ণ, কোনটা আসল মন '....
-থাম
আমি হাত তুলে থামিয়ে দিলাম বুনোকে।
-তুই আমার ফোনে হাত
দিয়েছিলি কখন?
-হা হা। তোর ফোনে কেন হাত দিতে যাব?
-থাব্রা চিনস?
-চিনি তো।
-হা। থাব্রা খাইতে না চাইলে বল আমার কয়টা ফোল্ডার চুরি করছিস?
-দশ মিনিটের জন্য ধরেছিলাম।তুই কফি আনতে গেছিলি। পনেরোশো গান দেখেই তো আমার মাথা ঘুরে গেছে।
-এত না প্যাঁচায়ে সোজা পয়েন্টে আয়।
-মাত্র তেরটা।
-আবার যদি আমার গানের ফোল্ডারে হাত দিয়েছিস! দেখবো তোর কলিজা কত্ত বড়।
-একদিন এমনিতেই দেখবি। আমার পুরো শরীরটাই কলিজা।
বুনোর হাসি দেখে আমার আত্মা কেঁপে গেল।কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। অথচ হাসলে বুনোকে কি ভীষণ ইনোসেন্ট দেখায়। আমি বুনোর হাসি দেখে আরেকবার শিউরে উঠলাম।কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ লাগছিল ওকে।
.
আমার দিন গুলো চলে যায়। সকালে উঠে দুটো টোস্ট, এক কাপ চা নাকে মুখে দিয়ে অফিসে দৌড়। আইটি ফার্মের ব্যাক্কল, ঘ্যাড়ত্যাড়া ঝামেলাগুলো সামলে
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত। দুপুরে যা হোক ক্যান্টিন থেকে কিছু একটা ফের নাকেমুখে গুঁজে দেয়া। নিজের রান্নার তো কথাই নেই। খেয়ে প্রথমে নিজেকেই শান্তনা দিতে হয়। এর মধ্যে রবিবার অফডে। সারাদিন ঘর গুছিয়ে দুপুরটা বাইরে খাই। বিকেলে কখনো এসপ্ল্যানেড বা গঙ্গার ধার থেকে একটু ঘুরে আসি।কোলকাতাতে আজকাল ঘোরার জায়গার বড্ড অভাব।বড্ড অভাব।
.
আজকাল ঋভুকে মনে করার সময় পাইনা রবিবার ছাড়া। গঙ্গার ধারে দাঁড়ালেই আমার বুকে এক ভীষণ ঝড় ওঠে আজও। দেশে থাকতে একদিন পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে ঋভুর সাথে খুব ঝগড়া করেছিলাম।ও আমাকে বলেছিল নদীটাকে কেন আমাদের খারাপ মুহূর্তের সাক্ষী বানাচ্ছিস?আমি কোনো উত্তর দেইনি । আমি ঋভুকে যতই ভুলে থাকতে চাইনা কেন।বুড়ো হাড়ে বাতের ব্যাথার মত ঠিক মনে পড়ে যায়।আজ রবিবার। ঘুরতে ঘুরতে বিকেলটায় ঠিক গঙ্গার পাড়ে চলে এসেছি।গঙ্গা, গরীবের সমুদ্র।একা একা বসে ঢেউয়ের আছড়ে পড়া দেখছিলাম। আচমকা কেউ কাঁধে হাত রাখতে আমি ভীষণ, ভীষণই চমকে উঠলাম।ঠিক এইভাবে ঋভু আমার কাঁধে
হাত রাখতো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার মত শক্তিও পেলাম না দেহে।
-কিরে? হঠাৎ ফ্রিজ হয়ে গেলি কেন?
বুনো! আমার শরীর শিথিল হয়ে গেল।
-তুই কি করছিস?
-তোকে খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম আরকি।
-কি দরকার শুনি?
-তার আগে বল তোর ফোন কই?
-কেন?
-কত্ত গুলা ফোন দিছি দেখছিস?
-স্যরি। ভুলে ফোন বাসায় ফেলে এসেছি।
-আর এমন ভুল করিস না অন্তত। আত্মা উড়ে যায়।
-আহা!
দুজনেই হেসে ফেললাম।
-অনি
-বল
-আমি তোদের দেশে যাব।
-কি করতে?
-ঘুরতে।
-যাবি।
-তুই যাবি না।
-না।
-তোর পাসপোর্ট রিনিউ করতে হবে না?
হেসে ফেললাম আমি।
-না
-কেন?
-আমার এক আংকল আছে। উনি হেল্প করেছে রিনিউ করাতে। আর পাঁচ বছর পর পর রিনিউ করতে হয়।আমি আরো চার বছর থাকতে পারবো।গতবছর করিয়েছি রিনিউ।
-অ
দুজনেই চুপচাপ বসে আছি।মাঝে মাঝে আমার কেমন ঘুণে ধরা ক্লান্তি লাগে। মনে হয় খুব একা হয়ে যাই।ভীষণ একা।
.
এক সপ্তাহ হয় বুনো অফিস আসে না। ভাবছি ওর বাসায় একটা ফোন করবো।
তক্ষুনি কেউ পাশ থেলে ভৌ করে উঠলো। তাকিয়ে দেখি বুনো।ওকে দেখে আমি আঁৎকে উঠলাম।উষ্কখুষ্ক চুল, ভাঁজহীন শার্ট, হলুদ দাঁত, রক্তলাল চোখ, হাতের নখের নীচে ময়লা।
-কি হয়েছে কি তোর?ছিলিস কোথায়?
বুনো কিছু না বলে আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চললো। গঙ্গার পাড়ে এসে চুপটি করে দাঁড়ালো।
-তোকে বলেছিলাম না একদিন দেখবি আমার পুরো শরীরটাই কলিজা। বলেছিলাম না?
-হ্যা
-আমার কলিজার সাইজ আসলে একটা পুঁটিমাছের সাইজের।
-কি হয়েছে বলবি তো?
-আমি ঋভুকে খুন করতে গেছিলাম।
আমি ভয়াবহ চমকে বুনোর মুখের দিকে তাকালাম।
-তোর সাথে আমার পরিচয় নয় বছর। তুই দেশ ছাড়ার আগে থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায়। আমি তোকে চাইতাম।ভীষণ করে। তুই ঋভুর অবহেলার কথা যখন আমাকে বলতিস। আমার তখন খুব ইচ্ছে করতো তোর কান্না শুঁষে নেই। তুই যখন নিজেকে অবহেলা করতিস। তখন আমার ইচ্ছে হতো তোকে কাছে টানি। গত ছয়টা বছর পাশাপাশি থেকেও আমি তোকে ছুঁতে পারিনি । না পেরেছি তোর সাধনা ভেঙে তোকে ছুঁতে, না পেরেছি তোকে রঙ দিতে।
-
-তাই আমি ভেবেছিলাম ঋভুকেই আমি খুন করে ফেলবো।তোর কাছে এত বছরে এতবার তোর দেশের কথা শুনেছি যে এয়ারপোর্টে নেমে আমার কিছুই অচেনা মনে হচ্ছিল না। আমি ঠিক তোর শহরে পৌঁছেছি।তোর মত করে তোর শহরের প্রতিটি অলিগলি ঘুরে দেখেছি। এমনকি ঋভুকেও পেয়েছি। ঋভুর সাথে কথা বলেছি।
-
-বলে আমার কি মনে হয়েছে জানিস?এই একটা জীবনে ঋভু আমাকে সব দিক দিয়েই হারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিজে যেটা হারিয়েছে সেটা আমি পেয়েছি।
-
-ঋভু এখন তোকে খোঁজে। চায় ভীষণ করে।গত ছয়টা বছর ও তোকে খুঁজেছে। ওর সেই অমূল্য হারানো সম্পদ তুই।তোকে আমি ছুঁতে না পারি। তোকে দেখছি।তুই আমার পাশে আছিস।আমি চাইলেই তোর সাথে কথা বলতে পারছি।যেটা ঋভু পারছে
না। আমার জিত এখানেই।
বুনো আমার সামনে মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর দুচোখে বেয়ে পানি ঝরছে। আমি তাকিয়ে আছি ওর দিকে। সময় থমকে গেছে। বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। সবাই স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করছে যেন কিসের। আমি নিচু হয়ে বুনোর
কপালে আমার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম।।

-ইশরাত জাহান অনিন্দিতা

Related Posts

: