সোনার পালঙ্ক

Post a Comment
love story, valobashar golpo, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প
বেয়ান কাইলে তহনো আন্ধার হয়্যা আছাল। আকাশে পাতিলের তলার লাহান কালা কালা মেঘ আমাগো গেরামের চাইরদিকে পাহারা বসাইছিল। যেন কেউ বাইর হইলেই ঘাড়ের উপরে চাইপ্যা বইবো। বাজান তহন পান্তা ভাত পিয়াইজে কামড় দিয়া খাইতাছিলো। আমি বাজানের শাটের বুতাম লাগাই দিতাছিলাম। আম্মায় কইলো, 'আইজ আর কামে যাইয়েন না। আকাশের ভাও ভালা ঠ্যাকতাছে না।'
বাজানে পান্তা মুখে পুইড়া কাঁচামরিচে কামড় দিয়া কইলো, 'কামে না গ্যালে তোর মাইয়্যার পেরাইভেটের টেকা দিমু কেমনে? মাস্টর ভালা মানুষ বইল্যা চায় নাই। কিন্তু আমাগো তো দেওন উচিৎ জলদি জলদি।' আম্মায় শাড়ির আঁচল মুখে কামড়াই ধইরা রাইখ্যা বাজানের থালায় পান্তা তুইলা দিতে দিতে কইলো, 'মাস্টররে আমি বুঝাই কবানি। আইজকা আপনে কামে যাইয়েন না। আমার মনে কু ডাকতাছে।'
বাজানে হাসে। বাইরে মেঘ ডাকে। টিনের চালে ফোটা ফোটা বিষ্টি পরে। আকাশের গোসসা ভাংতাছে একটু একটু কইরা। ছুডু ভাইবোইন দুইটা তহনো ঘুমাইতাছে। বইনটা ভাইয়ের গায়ে পা তুইল্লা দিছে। ভাইয়ের মাথা বালিশ থেইক্কা এক হাত দূরে হইরা গেছে। এই দুই জনের ঘুম মশার কয়েলের লাহান। হারা বিছনা বিছরাইতে থাহে। রাইতে কুস্তি লাগে দুই জনে। বইন কয় তুই আমার জায়গাত আবি না। ভাই কয় তুই আমার জায়গাত আবি না। কাইজ্জা লাগে হারা রাইত। আর ঘুমের পরে দুইটার কোন হুশ থাহে না। বাজানের শাটের বুতাম লাগায়া খেতাডা ওগো গায়ে তুইল্লা দিলাম।
বাজান ভাত খাইয়া বাইরের গিয়া হাত ধুইয়া দাওয়ায় বইস্যা লুঙ্গির ভাজের থেইক্কা বিড়ি নিয়া ধরাইলো। আমি বাজানের পায়ের কাছে গিয়া কইলাম, 'বাজান আইজকা কামে যাইও না।' বাজান আমার মাথায় হাত রাইক্ষা কইলো, 'আমার আম্মাজানে কইলে তো আর যাইতে পারি না। আইচ্ছা যা যামু না।' বাজানের শক্ত শক্ত হাত যহন আমার মাথাত রাহে আমার সারা শইলে কি যে শান্তি লাগে। মনে অয় দুইন্নাদারিতে আমার আর কিচ্ছু লাগবো না। বাজান খালি আমার মাথাত হাত দিয়া বইয়্যা থাউক।
আমি বাজানরে কইলাম, 'বাজান কিচ্ছা হুনাও। তোমার আর আম্মার বিয়ার কিচ্ছা।' বাজানে হাসে। বিড়িতে টান দিয়া ধুয়া ছাড়তে ছাড়তে হাসে। বাজান কইলো, 'এক কিচ্ছা আর কয়বার হুনবি আম্মাজান?' আমি তাও কই, 'কও না বাজান। আমি আরো মেলা বার হুনুম।'
বাজানে বিড়ি ফালায়া দিয়া মোড়া সরাই দিয়া আমার পাশে আইস্যা বইলো। বাজানের চোখ ঝিকমিক করতাছে। বাজান আকাশের দিকে চায়া কইলো, 'ঐদিন আছাল হাটবার। আমাগের দুইটা খাশি হাটবারে বেচতে নিছিলাম। হাটে যাওনের পথে তোর আম্মার লগে দেহা। হেয় একটা পান আর আংগুলের ডগায় চুন নিয়া খাড়ায়া আছাল...।' এমুন সময় আম্মায় পাকের ঘর থেইক্কা বাজানরে ধমক দিয়া কইলো, 'আপনে থামবেন! পুলাপানের কাছে কয়দিন বাদে বাদে এই কিচ্ছা আর কয়বার কইবেন। আমি কিন্তু বাড়ি থেইক্কা যামু গা।'
বাজান আর আমি হাসি। বাজান আরো জোরে কইরা কইতাছে, 'আমারে পান দেওনের সময় কইলো- আইজকা আমারে দ্যাখতে আইবো। কিছু করেন। নাইলে আমি গলায় দড়ি দিমু। এইডা কইয়া আমার আংগুলে চুন দিয়া শাড়ির আচলের নিচে থেইক্কা এক গাছি দড়ি বাইর কইরা দেখাইলো। আমি তো গেলাম ঘাবড়াইয়া। মাইয়্যা ছাওয়ালের বুদ্দিসুদ্দি কম। গলায় যদি দড়ি দেয়। আমি পান চাবাইতে চাবাইতে কইলাম খালি- দেহি কি করোন যায়। তুই তৈয়ার হই থাইস। তোগো চালে ঢিল পরলেই বাইর হইয়্যা মুন্সিগো ঘাটায় আইস।
'এই কইয়্যা আমি হাটে চইলা গেলাম। পরানে আমার পানি আছাল না আম্মাজান। খালি তোর আম্মার দেহানো ঐ দড়ির কথা মনে পরতাছিলো। যদি গলায় দড়ি দেয়।' আমি আম্মারে ডাক দিয়া কইলাম, 'আম্মা তুমি কি সত্য গলায় দড়ি দিতা?' মায়ে পাকের ঘর থেইকা বাইর হয়্যা আমার মাথায় বাড়ি দিয়া কইলো, 'ঐ ছেমড়ি তোর শরমলইজ্জা নাই বাপ মায়ের বিয়ার কিচ্ছা হুনোস।' আমি তাও আম্মারে জিগাই, 'কও না আম্মা সত্য গলায় দড়ি দিতা?' আম্মায় বাজানের দিকে চোখ কটমট কইরা কইলো, 'ঐদিনই আমার গলায় দড়ি দেওন উচিৎ আছাল। নাইলে আইজকা তোর বাজানে বেশরমের মতো এই কিচ্ছা কইতো তোরে!'
আম্মায় পাকের ঘরে চইল্যা গেল। বাজান আর আমি হাসতে হাসতে আম্মার চইল্যা যাওন দেহি। বাজানে আবার শুরু করলো, 'আমি আধবেলা হাটেই হস্তায় খাসি দুইটা বেইচা দিলাম। ঠিক করলাম তোরে আম্মারে নিয়া পলায়া যামু। যেই টেহা আছে ঐ টেহা দিয়া নিকাহ্ কইরা আরো দুই মাস চলোন যাইবো। হাটে থেইক্কা আর বাড়ি যাই নাই। সিধা তোর আম্মার বাড়ির চালে দুইডা ঢেল দিয়া মুন্সিগো ঘাটায় চইল্যা গ্যালাম। আমার দোস্তরে আগেই কইয়্যা রাখছি নাও নিয়া ঘাটে থাকবার। তোর আম্মায় হাতে একটা পুটলি নিয়া আইলো। আমি কইলাম কি আনছো? দড়ি নিকি। তোর আম্মায় চোখ কটমটাইয়া কইলো- হ গরু বান্ধনের দড়ি। হুইনা আমি আর দোস্ত হাসতে হাসতে নাওয়ে উইডা বসি। তোর আম্মায় নাওয়ে বইতেই ছইয়ের মুখে ছালার পর্দা দিয়া দিলো দোস্ত। মাইয়্যা ছাওয়ালের বুদ্দিসুদ্দি কম জানতাম। কিন্তু ঐদিন বুঝবার পারছিলাম তোর আম্মার কত বুদ্দি।
'টেহা পয়সা যা পাইছে নিয়া আইছিল। গয়না আনতে পারে নাই। যহন কইলাম বাপের টেহা চুরি কইরা আনলা। তোর আম্মায় ঝেমটা দিয়া কইলো, আমার সম্পত্তির যেই ভাগ পাওনের কথা তার থেইক্কা কমই আনছি। আপনের মতো একটা ডাকাইতের লগে ভাগতাছি। বাড়িত আর আইতে পারুম কোনো কালে? যা পারছি লইয়্যা আইছি।'
আকাশ থেইক্কা কালা কালা মেঘ গুলান গইল্যা গইল্যা আমাগো টিনের চালে পরা শুরু করলো। দরজার কাছে আইস্যা আমি আর বাজান বইলাম। ভাইবোইন দুইডা ঘুমের মইধ্যে খেতা টানাটানি করতাছে। বাজান আবার কইতে শুরু করলো, 'হেইদিনও এইরাম আছাল আকাশ। নদীর মইধ্যে ঝড় উঠলো। ওরে তুফান। এই বড় বড় ঢেউ দিতাছিলো। তোর আম্মায় জোরে জোরে দোয়া ইউনুছ পরতাছিলো। আর এমুন কইরা আমারে ধইরা রাখছিল আমি হাত নাড়াইতে পারতাছিলাম না। দোস্ত আমার হেই তুফানরে বুইড়া আংগুল দেহাইয়া পাড়ে নিয়া ভিড়াইলো নাও। অচিন গেরাম। চিনি না কিছুই। ঘাটার একটু দূরেই মসজিদ। ঐহানে গিয়া মাথা গুজলাম।
'মসজিদের মুয়াজ্জিন সাব কইলো- আপনেরা কই থেইকা আইছেন, কই যাইবেন? আমার কিছু কওন লাগে নাই। দোস্তই মুয়াজ্জিন সাবরে আড়ালে নিয়া গিয়া কি সব কইলো। বাদে কইরা মুয়াজ্জিন সাব আর দোস্ত হাসি হাসি মুখ নিয়া আইলো। মুয়াজ্জিন কইলো- আমি সব হুনছি। আল্লাহ্‌র হুকুম থাকলে বিবাহ আপনেগো হইবোই। আমি আরেকজন সাক্ষীর বেবুস্থা করতাছি। আপনেরা আহেন আমার লগে। আমার ঘর মসজিদের পিছে। আমার বিবি আর দুই কন্যা সন্তান নিয়া থাহি। আহেন আপনেরা।
'আমি তো কিছুই বুঝতে পারতাছিলাম না। দোস্তরে জিগাই কেমনে কি হইতাছে। দোস্ত আমারে ধমক দিয়া কইলো চুপ থাক। ভাবীরে নিয়া আয়। তোর আম্মায় আমার দোস্তরে কইলো- আপনের দোস্ত এমনে এমনে যাইবো না। গরু বান্দনের দড়ি নিয়া আসেন। বাইন্দা নিয়া যান। দোস্ত হাইস্যা কইলো- ভাবীসাব যা বান্দার আপনেই বাইন্দেন। সব আল্লাহ্‌র ইশারা।
'নিকাহ্ হইয়্যা গ্যালো তোর আম্মার লগে। ঝড়ও থামলো। দোস্ত রওনা দিয়া দিলো। তহনো কি জানতাম ঐডাই আছাল দোস্তর লগে আমার শ্যাষ দেহা। আর কুনোদিন দোস্তরে দেহুম না যদি জানতাম হেই সময় কি আর ছাড়তাম। কিন্তু মাথায় আছাল নয়া বউয়ের চিন্তা। আমি কি আর তহন দুইন্নাদারিতে আছি রে আম্মাজান। দোস্ত যাওনের সময় তোর আম্মার হাতে কিছু টেহা দিয়া কইলো- ভাবী আমি গরীব মানুষ। আপনেগোরে কিছু দিবার সাইধ্য নাই। এই তোফা যদি রাহেন আমার দিল শান্তি পাইবো। না কইরেন না। দোস্ত চইল্যা যাইতেই তোর আম্মায় কইলো- দুনিয়াতে আপনে যদি কোন ভালা কাম করেন তার মইধ্যে একটা হইলো এমুন একটা মানুষরে দোস্ত বানাইছিলেন।'
বাজানের দিকে তাকায়া ছিলাম। বাজানের চোখ এই হাসতে থাহে। এই আবার কান্দে। বাজানের কাছে এই কিচ্ছা আমি মেলাবার হুনছি। তাও মেলাবার হুনতে মনচায়। বাজানের দোস্ত যাওনের সমুই আবার ঝড় উঠছিল। ঐ ঝড়রে আর বুড়া আংগুল দেহাইতে পারে নাই। বাজানের গেরামের এক চাচার লগে দুই বছর বাদে দেহা। উনি কইছিল, বাজান যেইদিন আম্মারে নিয়া পলাইলো হের পরদিন বাজানের দোস্তর লাশ পাওন যায় বনরূপা গেরামের কাছে। বাজান এই কিচ্ছা কইলে এরপরে আর কিছু কইতে পারে না। খালি আকাশের দিকে তায়া তাহে। আম্মায় পাকের ঘর থেইক্কা ফুপাইয়্যা ফুপাইয়্যা কান্দে।
বাজান দোস্তরে বিদায় দেওনের সমুই যহন বাজানে নাও ঠেইল্লা দিছিলো তহন উনি কইছিলো, 'দোস্ত তোগো ঘরে আমার লাইজ্ঞা একটা খাট রাহিস। কুনো একদিন আইস্যা যামু। তোগো লগে থাহুম। রাহিস কিন্তু।' বাজানে হাইসা কইছিলো, 'রাহুম দোস্ত রাহুম। তুই যতদিন না আইবি ঐ খাটে কাউরে ঘুমাইতে দিমু না।'
আমাগো বাড়িত আমরা পাচটা মানুষ। দুইটা ঘর। এক ঘরে বাজানে উনার দোস্তর জন্যি খাট বানায়া রাখছে। আমি জনমের পর থেইকাই দেখতাছি। ঐ খাটে বাজানে কাউরে বইতে দেয় না। হুইতে দেয় না। মেহুমান আইলেও দেয় না। কিন্তু খাটে সব সমুই নয়া চাদর থাহে। আম্মায় প্রেত্যেকদিন ঐ বিছনা ঝার দেয়। আমরা বেবাগতে জানি বাজানের দোস্ত আর আইবো না। কিন্তু আমার বাজানে, আমার আম্মায় ঐ দোস্তর জন্যি এই খাট সারা জেবন রাইখ্যা দিবো। এই খাট বাজানের কাছে সোনার পালঙ্ক। উনার দোস্তরে উনি কথা দিছিলেন। উনি কথা রাখছেন।

সোনার পালঙ্ক || শাকিল রনি
৩০০৮১৮

Related Posts

: