শ্রাবণ ধারায় পেয়েছি তোমায়

Post a Comment
love story, valobashar golpo, ভালোবাসার গল্প, প্রেমের গল্প, ভালবাসার গল্প
"বাহিরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে,চলো না একটু ভিজি?"
নীলার কথাটা শুনে আমি ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে সাদা ফ্রেমের চশমাটা খুলে বললাম,'নাহ্ একদমই না।তোমার বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে,সেটা কি ভুলে গিয়েছো?
-নাহ্ একদমই ভুলি নি।তবে আজকের বৃষ্টি,কেন যানি আমাকে টানছে,তার উষ্ণ পরশে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য।চলো না একটু খানি ভিজবো।
-না,বৃষ্টিতে ভিজলে হবে না।আর আমার গলা অবধি কাজ পড়ে আছে।জরুরি এসাইনমেন্ট টা আগামী দু'দিনের ভিতরে জমা দিতে না পারলে এড ডি স্যার খুব বকাবকি করবে আমাকে।
-তুমি সবসময় তোমার কাজ নিয়েই পড়ে থাকো।আজকে শুক্রবার,অফিস ছুটি।কোথায় একটু আমাকে সময় দিবে,তা না করে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছো।
থাকো তোমার ল্যাপটপ নিয়ে,আমি রান্নাঘরে গেলাম।
নীলা একরকম রাগ দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।আমি আবার ল্যাপটপের দিকে মনোযোগ দিলাম।বিয়ে করেছি মাস তিনেক হবে।
নতুন চাকরি,তারউপর আবার নতুন সংসার।সবকিছু একসাথে গুছিয়ে নিতে বেশ একটু কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু সে কথাটা এই মেয়েকে কে বুঝাবে?
বড় লোক ঘরের মেয়ে নীলা,একে অপরকে ভালোবসে ছিলাম ভার্সিটিতে থাকতে।
টানা চারবছর রিলেশন করার পর,নীলার বিয়ে ঠিক হলে সে তার বাবাকে সরাসরি বলে দেয়,"বিয়ে যদি করতেই হয়,তবে আমাকেই করবে।
প্রথমে একটু নাহু নাহু করলেও মেয়ের জেদের কাছে ঠিকি হার মেনে যান,নীলার বাবা।আর তারপর আমার বাবা-মা কে ডেকে একটা ভালোদিন দেখে বিয়ে করিয়ে একছাদের নিচে থাকার পাক্কা বন্দবস্ত করে দেন সবাই মিলে।
বেশ সুখে আছি আমরা,তবে মাঝেমধ্যে নীলার খামখেয়ালির জন্য সামান্য বেগও পেতে হয় আমাকে।
এই যে একটু আগে জেদ করে রাগ দেখিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো মেয়েটা।
এখন রাগের বশে তরকারিতে মাত্রাতিরিক্ত মরিচ গুড়া ঢেলে দিবে।
আর সেগুলো আমাকে হাসি মুখে খেতে হবে।
আগে অবশ্য ঝাল কম খেতাম,তবে বিয়ের পর নীলার জন্য ঝাল বেশি করে খেতে হয় এখন।
কারণ তার নাকি ঝাল কম হওয়া তরকারি খেতে পানির মত লাগে।
ল্যাপটপ টা সরিয়ে রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।
ছাদের ব্যালকুনি দিয়ে ফিঁকে আসা সামান্য বৃষ্টির আঁচ গায়ে লাগতেই শরীরের ভিতরে অন্যরকম একটা অনুভূতির জানান দিয়ে দিলো।
হ্যা,এই রকম একটা মুষলধার বৃষ্টির দিনে নীলার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিলো।অবশ্য পরিচয় টা একটু অন্যরকম ভাবেই হয়েছিলো আমাদের।
সেদিন জরুরি একটা কাজের জন্য গুলশানের চার নং সেক্টরে গিয়ে,ফেরার পথে বৃষ্টির পানিতে ধরেছিলো আমাকে। প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য একটা শপিংমলের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।ছাতা না থাকাতে এক প্রকার নিরুপায় হয়েই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
এমন সময় পিছন থেকে অচেনা একটা মেয়ে বলে উঠলো,"ব্যাগ গুলা ধরবেন একটু?
-এই যে হ্যালো,ব্যাগ গুলা ধরতে বলছি না আমি।কথা কি কানে যাই না?
পিছনে থাকা মেয়েটার কড়াস্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম,একটা মেয়ে হাতে কতগুলো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হাল্কা করে কাজল দেওয়া চোখ গুলি ভাসা ভাসা,যেন ছোট্ট দুটিতে নীল পদ্ম বসিয়ে রাখা আছে চোখের মাঝখানে।পরনে নীল রংয়ের একটা গাউন,আর তার সাথে ম্যাচিং করে কানের দুল আর চুড়ি।
-এই যে হ্যালো,আশ্চর্য তো!কথা কি কানে যাই না,নাকি কান খুলে রেখে এসেছেন বাসায়?
এইসব সিকিউরিটি যে কি দেখে রাখে বুঝি না।
সিকিউরিটির কথা শুনে হুশ ফিরলো আমার।তবে কিছু বলার আগেই মেয়েটা তার হাতে থাকা ব্যাগ গুলি ধরিয়ে দিয়ে বললো,এই গুলা গাড়িতে রেখে আসেন।
মেয়েটার মায়াভরা মুখটা তখন আমাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিলো যে আমাকে সিকিউরিটি কেন তার গাড়ির ড্রাইভার বললেও মাইন্ড করার মত অবস্থা ছিলো না আমার ভিতরে।
আমি নির্বাক হয়ে,শুধু তার চোখ দুটিকে দেখছিলাম অপলক দৃষ্টিতে।
ব্যাগ গুলি নিয়ে বার হতে যাবো,ঠিক তখনি শপিং মলের সিকিউরিটি এসে সামনে দাঁড়ালো।
-ম্যাডাম, আমি দুঃখিত।
দিন আমাকে ব্যাগ গুলো দিন,আমি রেখে আসছি।
-আপনি সিকিউরিটি হলে ইনি কে?
সিকিউরিটি আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জিতভরে বললো,'সরি স্যার,আমার জন্য আপনাকে,এক্সট্রিমলি সরি।
-উনি এখানকার সিকিউরিটি নয়?
-জ্বি না ম্যাডাম, উনিও আপনার মতই একজন কাস্টমার।
-ওহ্,সরি।আমি সিকিউরিটি ভেবে কি না কি বলে ফেলেছি।আপনি কিছু মনে করেন নি তো।
ওহ্ হ্যালো।
নীলার কথাতে স্বাভাবিক হয়ে বললাম,'না,সমস্যা নেই।
-আমি এক্সট্রিমলি সরি,আসলে বুঝতে পারি নি আমি।
-ইটস ওকে।
আর এভাবেই আমার নীলার সাথে প্রথম দেখা হয়। তখনো ওর নামটা অজানা ছিলো,তবে আমি নিজের থেকে একটা নাম দিয়েছিলাম,নীলাবতী।
নামটা একটু সেকেলে হলেও,নামটার সাথে এই অজ্ঞাত মেয়েটার হুবহু মিলে যায়।
দ্বিতীয়বার যখন নীলার সাথে দেখা হয়,সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিলো।আমি বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্ট গিয়েছিলাম।
-দোস্ত কি খাবি?
-অর্ডার দে,তোর যা খেতে ইচ্ছে করে।
তারপর বন্ধুদের সাথে গল্পতে মেতে উঠার এক পর্যায়ে চোখ পড়ে নীলার দিকে।নীলাও তখন রেস্টুরেন্টে ঢুকছিলো।আমাকে দেখে নীলা প্রথম এগিয়ে আসে,সেদিনের ভুলের জন্য সরি বলতে।
আর তারপর প্রথম নীলার নামটা জানতে পারি।নীলাবতী থেকে নীলা,আমার ভাবনার দেওয়া নামটা খুব একটা বিফলে যাই নি।
নীলা সেদিন নিজ থেকেই আমার ফোন নং টা নিয়েছিলো।
আর তারপর থেকে মুঠোফোনে টুকিটাকি কথা,একে অপরের খোঁজ নেওয়া।
এভাবেই চলছিলো।
একটা সময় আমরা অজ্ঞাত দুটি মানুষ চিরচেনা দু'জন বন্ধুতে পরিনত হয়।
আর তার কয়েকমাস পর নীলা নিজ থেকেই আমাকে তার ভালোবাসার কথা বলে। হুমায়ূন আহমেদ হয়তো ঠিকি বলেছিল,'একটা সমবয়সী ছেলে আর মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারে না,একটা সময় ভালোবাসার ঘ্রাণ তাদেরকে আকৃষ্ট করবেই,তা হোক সঠিক সময়ে বা বুড়ো বয়সে।
অবশ্য এইক্ষেত্রে নীলার অবদানই বেশি ছিলো।
আমি সাধারণত মুখচোরা স্বভাবের একটা ছেলে,মনের কথা কখনোই নীলাকে হুট করে বলতে পারতাম না।
কিন্তু নীলা আমার মনের কথাটা বলে দিয়ে সে দিকটা সহজ করে দিয়েছিলো।
আর এভাবেই আমাদের ভালোবাসার সূচনা ঘটে।আর তারপর তো প্রথমেই বলেছি।
হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে অতিত ছেড়ে বেরিয়ে আসলাম।
রান্নাঘর থেকে গরম বিরিয়ানির ঘ্রাণ নাকে ভেসে আসছে।
এই জন্য নীলাকে আমার এতো ভালো লাগে,কেন যানি মেয়েটা আমার মনের কথা অকপটে বুঝে যাই।
একটু আগেও আমি সেটাই ভাবছিলাম,বর্ষার দিনে বিরিয়ানিটা হলে মন্দ হতো না।
সে যাই হোক,বিরিয়ানির লোভ আর সামলাতে পারছি না,রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলাম,নীলা কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে মনোযোগ দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করছে।
আর মাঝে মধ্যে সামনে ঝুঁকে আসা চুল গুলা ফু দিয়ে সরানোর চেষ্টা করছে।
ভারি মিষ্টি লাগছে দেখতে ওকে,ইচ্ছে করছে পিছন থেকে গিয়ে জাপটে ধরে বুকের ভিতরে লুকিয়ে ফেলতে।
কিন্তু নীলা তো এখন রেগে আছে,তবুও সাহস করে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।
নীলা অভিমানী কণ্ঠে বললো,"ছাড়ো তো, এখন আসছে আদর দেখাতে।আমার কাজে একদম বাঁধা দিবে না।তখন তো নিজের কাজটা ঠিকি মনোযোগ দিয়ে সেরেছো।
আমি নীলার কথার কোন জবাব না দিয়ে সোজা কোলে তুলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম।
এখনো ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে।ছাদটা যেন সীমাহীন এক নীল সমুদ্র।আর আকাশ টা তার পানির উৎস।
নীলা চোখ বন্ধ করে বলছে,"ছাড়ো তো,কি করছো সবাই দেখবে তো!
আমি ওর নাকে আলতো করে আমার নাকটা ছুঁয়ে দিয়ে বললাম,"দেখুক,আমি কি ভয় পায় নাকি?দেখো আজকেও সেদিনের মত করেই বৃষ্টি ঝরে পড়ছে।
তবে সেদিন তোমার হাতে ব্যাগ ছিলো,আর আজ আমার হাতে তুমি আছো।
সেদিন ভুল ক্রমে শপিংমলের সিকিউরিটি ছিলাম,আর আজ ইচ্ছে করেই তোমার মনের সিকিউরিটি হয়েছি।
নীলা চোখ দুটি খুলে লজ্জাভরে বললো,"সেদিনের জন্যই কিন্তু,তুমি আমাকে পেয়েছো।
-হুম,সিকিউরিটির দায়িত্বটা কিন্তু ভালোই ছিলো কি বলো।
নীলাকে নামিয়ে দিতেই বুকে মাথা রেখে বললো,"ভালোবাসি।
আমিও নীলার কপালে আলতো করে ঠোটের স্পর্শ লাগিয়ে বললাম,"খুব খুব খুব বেশি ভালোবাসি।
-এখন ছাড়ো তো,নয়তো আমার এতো যত্নের বিরিয়ানি শেষমেশ পশুপাখি খেয়ে পেট ভরাবে।
পুড়ে যাবে তো।
ওরে বিরিয়ানি,শেষমেশ তুই ও আমাদের ভালোবাসাতে ভাগ বসিয়ে দিলি।

Related Posts

: