একটা নরমাল রেস্টুরেন্টে বসে দুপুর প্রায় তিনটার দিকে ডাল, ভাত খেয়ে ক্লান্ত হয়ে সানজুকে কল দিচ্ছিলাম। কিন্তু সানজুর ফোন বন্ধ। কোনো সময় বন্ধ থাকে না ভাবলাম হয়তো চার্জ নাই তাই অফ।
আমি বের হয়ে আমার কাজ করতে লাগলাম দোকানে মাল অর্ডার দিচ্ছিলাম। ফাঁকে আবারো কল দিয়ে দেখি ফোন অফ। প্রায় ৪০ মিনিট পর কল দিয়েছিলাম৷ হঠাৎ সন্দেহ লাগায় দ্রুত অর্ডার শেষ করে ৪টার দিকেই বাসার দিকে রওনা দেয়। আসার সময়ও ট্রাই করি। ফোন অফ।
বাসায় এসে দরজায় কয়েকবার ঠুকা দিলাম। ভেতর থেকে শুধু আমার দেড় বছরের মেয়ে সামিয়ার কান্নার আওয়াজ আসছে৷ ডাক দিলাম সানজু বলে কয়েকবার। তাতেও রেসপন্স না পেয়ে ৫ তলায় থাকা বাড়ির মালিক আকবর চাচার কাছে গেলাম। চাচার কাছে যেতেই চাচা বললো, "এসেছো রায়হান, এই নাও তোমার বউ সানজু আমাকে চাবিটা দিতে বলেছে তোমাকে।"
মুহূর্তে আমি চাচাকে বললাম, "কি বলছেন চাচা এসব? চাবি আপনাকে দিয়ে গেছে মানে? ঘরের ভেতর দেখি সামিয়ার কান্নার আওয়াজ৷ তাছাড়া সানজুর ফোন বন্ধ। আপনার হাতে বাসার চাবি। কিছু তো মাথায় ঢুকছে না চাচা!"
"কি বলো রায়হান? আমি নিজেও তো বুঝতেছি না। চলো গিয়ে দেখি।"
দু'জনে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেখি দোলনাতে সামিয়া কাঁদছে। কিন্তু কোথাও সানজু নেই। সামিয়াকে আকবর চাচা কোলে নিয়ে আদর করছে। এদিকে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ চোখ পড়ে বিছানায় একটা ভাঁজ করা কাগজ। কাগজ টা হাতে নিয়ে পড়ে দাড়ানো থেকে ফ্লোরে বসে পরলাম। চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "কি হয়েছে রায়হান?"
ততক্ষণে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে৷ কেঁদে চাচাকে বললাম, "চাচা রে সানজু পরপুরুষের হাত ধরে পালিয়ে গেছে।"
"কিহহহহ! কিছু তো বুঝলাম না।"
চাচা আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়ে দেখে অবাক হয়ে যায়। চাচাকে বললাম, "চাচা মেয়েরা এটাও পারে। কেমন মেয়ে হলে এরকম করতে পারে। একটা মেয়ে আমাকে ছেড়ে গেছে সমস্যা নেই। কিন্তু সাথে একটা দেড় বছরের বাচ্চাকেও কিভাবে ফেলে চলে যেতে পারে বলবেন?"
চাচা আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি জোরে জোরে চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিয়েছি। ফ্ল্যাটের অনেক লোকজন আমার বাসায় ঢুকে পড়ে। ঘটনা কি বুঝার জন্য। ঠিক এই মূহুর্তে আমার কি করা উচিত আমি ভেবে বুঝতে পারছি না।
চাচা আমাকে সহ সামিয়াকে নিয়ে দরজা লক করে উপরে উনার বাসায় নিয়ে যায়। তারপর আমাকে বুঝানোর, শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। চাচার বউ নাই, ছেলে নাই নিঃসন্তান। বউ অনেক আগে মারা গেছে। চাচার বাসায় একটা পারম্যানেন্ট কাজের বুয়া আছে। উনার কোলে সামিয়াকে দিলাম কিছু খাওয়ানোর জন্য। আমি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ি।
আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলাম। আমি রায়হান। আমার পরিবারে বাবা-মা আমি ও বড় ভাই। বাবা ভাই বিদেশে থাকে। ঠিক ৪ বছর আগে সানজুর সাথে আমার পরিচয় কলেজে। আমি যখন সেকেন্ড ইয়ারে সে পড়তো ফাস্ট ইয়ারে। সানজুরা নিম্নবিত্ত দুই বোন এক ভাই। সানজু বড়, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। ভালোই চলছিলো আমাদের প্রেম।
হঠাৎ আমার এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন ফেরার সময় একদিন ফোন দিয়ে জানায় তাকে দেখতে আসছে বরপক্ষ। ঘটক লাগিয়েছে তার বাবা। নিম্নবিত্ত পরিবার আর সম্ভব না লেখাপড়া চালানো। আমার পরীক্ষা শেষ হয়। তারপর সে আমাকে জানায় পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে নিয়ে।
আমরা দুজনই পরিবারে জানালাম আমাদের কিছু একটা করে রাখা যায় কিনা। বিনিময়ে সানজু বাবা-মা'র মাইর খেয়েছে৷ আর আমিও ঘরে অনেক কথা শুনলাম।
তাই কি আর করা পরীক্ষার একমাস পর ভালোবাসার টানে কলেজে আসার ভান করে আমি আর সানজু পালিয়ে যায়। আমি ও সানজু বাড়ি থেকে মাস খানেকের কিছু খরচের জন্য টাকা, গহনা চুরি করে সাথে নিয়ে আসি। সাথে কিছু ডকুমেন্ট চাকরির জন্য। এতে আমার কলেজ ফ্রেন্ড আবির আমাদের সাহায্য করে। আমাদের দু'জনের সিম ভেঙে ফেলি। যাতে পরিবার আমাদের ধরতে যোগাযোগ করতে না পারে।
তারপর দু'জনে চট্টগ্রামের মফস্বল শহরে ছোট একটা কমদামি ব্যাচেলর বাসায় উঠি আগে। বাসার মালিক ভালো ছিলো। কোনোমতে বুঝিয়ে বাসায় উঠেছিলাম। আবিরের এক পরিচিত বড় ভাই শহরের একটা ফুড কোম্পানিতে হিউম্যান রিসোর্স(এইচ. আর.) পদে জব করতো। আলতাফ নাম৷ লোকটা প্রচুর ভালো। আবির আলতাফ ভাইকে বলে আমাকে সেলস এন্ড মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয় খুব সহজে। চাকরি ভালোই চলছিলো। শুরুতে ১৫ হাজার টাকা পেতাম। তা থেকে ৭ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে বাকি টাকায় কোনোরকম চলে যেত। বাসাটা একদম রঙহীন ঝড়ে পড়া টাইপ। এক বছর পর বেতন বিশ হাজার হয়। চাকরিতেও আমি বেশ ভালো মার্কেটিং করতে থাকি।
সানজু নিম্নবিত্ত, তাই ভেবেছিলাম তার খুব একটা বড় কোনো চাহিদা থাকবে না। কারন ধরে নিয়েছি, সে নিজেই এমন পরিবার থেকে এসেছে সে বুঝতে পারবে সংসার চালানো কেমন কঠিন। কিন্তু না আমার ধারণা ভুল ছিলো। সংসারের প্রায় দুই বছরে, এক বছর পর থেকে সানজুর আচরণ কেমন যেন হয়ে গেল। চেহারায় কেমন যেন একটা অপূর্ণ ভাব দেখতে পেতাম। জিজ্ঞেস করলে বলতো কিছু না। তারপর ঠান্ডা মাথায় আমাকে খুন করে দিয়েছে।
সে মাঝেমধ্যে কিছু কিনতে বের হত। মার্কেটে এই নিশাদের সাথে কোনোভাবে পরিচয় হয়। এভাবেই নিশাদ নামের বড় লোকের সাথে চলে গেছে। যাওয়ার আগে তাকে দেওয়া সিমটা ভেঙে দিয়েছে। আমার কাছে নাকি সে সুখী নয়।
আমার চোখ দু'টো লাল হয়ে গেছে। প্রায় এক ঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে চাচার লিভিং রুমে বসলাম। চাচা বললো, "কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো বাড়ি কি যাবে?"
"না চাচা এই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়া কখনো পসিবল নয়।"
"তাহলে কি করবে?"
"চাচা আপনার তো সন্তান নেই। আমার মেয়েটাকে আপনি বড় করুন। আপনার কাজের বুয়ার হাতে। আমি জানিনা তাকে কি পরিচয় দেবো।"
"আমিও তাই ভাবছি রায়হান।"
"আচ্ছা চাচা চাবিটা দেন আমি একটু বাসা থেকে আসি।"
চাচার কাছ থেকে চাবি নিয়ে বাসায় এসে ভালো করে চেক করি আর কিছু রেখে গেছে কিনা। কিন্তু পেলাম না কিছু। তখনি ভাবি কি পাপ করেছিলাম যে আমার এমন হলো?
পরক্ষণেই মনে হলো। হ্যা আমিতো গুরুতর অপরাধ করছি। আমি বাবা-মাকে কষ্ট দিয়ে চলে আসলাম। এই অপবিত্র ভালোবাসার জন্য বাবা-মা'র সাথে কথা বলিনি ফোনে। সম্পর্ক পুরো বিচ্ছিন্ন। এখন আমি কি করে বাড়ি গিয়ে মুখ দেখায়। লেখাপড়াও গেল। সংসারও গেল। চাকরিও মোটামুটি।
দুই বছর পর...
অনেক দক্ষতার সাথে বসের মনজয় করতে পারায় বস আমাকে এইচ. আর. বানিয়ে দিলো। এই তো ২ মাস হয়েছে। আমার বেতন প্রায় ৫৫ হাজার। আলতাফ ভাইয়ের সহযোগিতায় আরো সহজ হলো এইচ. আর. হতে। সানজু চলে যাওয়ার পর প্রায় ৫টা মাস খুব যন্ত্রণা ভোগ করেছি প্রতিরাতে। তারপরও দিনে রোবটের মতো কাজ করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি।
সানজু চলে যাওয়ার পর আকবর চাচা আমার থেকে আর বাসা ভাড়া নেননি। ফ্রি থাকতাম চাচার সাথেই। সামিয়া আকবর চাচার কাছে দাদা ও বুয়ার কাছে দাদীর পরিচয় পেয়ে বড় হচ্ছিল। আর আমি তার বাবা পরিচয় দিতাম। মায়ের কথা যেন মাথায় না আসে এমন ভাবে চলতাম সবাই।
সানজুর কোনো খোঁজ-খবর পাইনি। এইচ. আর. হওয়ার পর বাড়িতে যায়। অনেক কথা শুনি, মা'য়ের মাইরও খেয়েছি। কয়েকদিন পর সব শান্ত হয়ে আসে। মাকে সবকিছু বুঝায়। বাবা, ভাই সবার সাথে যোগাযোগ করি। আমি স্বাবলম্বী হতে পেরে আম্মা আমার কষ্ট বুঝে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আমিও আর না করিনি। নিজের বিয়ের জন্য অফিস থেকে ১০ দিনের ছুটি পাই। মায়ের পছন্দে মেয়ে ঠিক করা হয়। এমনকি একটা চুক্তিপত্র হয় আমার মেয়ে সামিয়াকে বড় করতে হবে। সাথে থাকবে।
হঠাৎ বিয়ের চারদিন আগে সকাল সকাল কোথায় থেকে কিভাবে যেন খোঁজ নিয়ে সানজু আমার বাড়িতে আসলো। তাকে দেখে আমি কি করবো বুঝতেছিলাম না। সানজুকে আলাদা করে বাহিরে দূরে একটা রেস্টুরেন্টের পার্কে নিয়ে যায় তখনি। এক ঘন্টা কথা হয়। যা জানতে পারি নিশাদ বড় লোকের ছেলে। সে সানজুর শরীর ভোগ করার জন্য এসব করেছিলো। প্রায় ২০ বারের মতো নানা জায়গায় নিয়ে টাকা উড়িয়ে থেকে সানজুকে ফাঁদে ফেলে ভোগ করেছিলো। সানজু টাকার কাছে হেরে গিয়েছে তখন। তারপর তার শখ মিটলে সানজুকে ছেড়ে দেয়। এরপর সানজু পথ না পেয়ে কোনো এক বাসায় বুয়ার কাজ শুরু করে জীবন চলছে।
দুজনের মাঝে এখন নীরবতা ভর করেছে। সানজু বললো, "আমি তোমাকে এখনো ভালোবাসি। আমাকে ফিরিয়ে নাও প্লিজ রায়হান।"
আমি মুচকি একটু হেসে বললাম, "তা আর হবেনা। সরি। প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড়ে না। তোমার জন্য পরিবার, লেখাপড়া ছেড়ে আমি সংসারে নেমেছিলাম। সেই অভিশাপে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। তাও নিজের একটা সন্তান সহ রেখে। কত বড় অমানুষ হলে একজন নারী এই কাজ করতে পারে। কত মাস ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট সহ্য করে একটু উচ্চতায় পৌঁছেছি। নিজেকে স্বাবলম্বী করেছি। তোমার ফল বাকি ছিলো। এবার তোমারটাও তুমি পেয়েছো। ভুগতে থাকো।"
সানজু কান্না জুড়িয়ে দিলো। মাফ চাইলো। আমার একটুও মায়া হচ্ছে না পাষাণির জন্য। শেষবারের মতো বললাম, "শোনো আর ঝামেলা করবে না। আমার বিয়ে চারদিন পর। আম্মা মেয়ে ঠিক করেছে। সো আমার পরিবারের অশান্তি হয় এমন কিছু করতে গেলে তোমার সমস্যা হবে। গেলাম বাই।"
: