একটা মেয়ের গল্প

Post a Comment

ফোনটা ভাইব্রেট করেই চলেছে।
স্ক্রিনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, হাত কাঁপছে।
এতদিন, এতবছর পর আবার সেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে বিশ্বাস হচ্ছে না।
আজও নাম্বারটা দেখে হৃদস্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে যায়, মনের মাঝে প্রবল ঝড় বয়ে যায়, শেষপর্যন্ত রিসিভ করে ফেললাম।
ওপাশ থেকে ভেসে এল সেই পরিচিত কন্ঠস্বর।
এতবছর পরও একটুও বদলায়নি। সেই আগের মতই আছে।
হ্যালো...
.
.
.
কি হল? কিছু বলছ না যে?
না! আসলে পাঁচ বছর পর এই নাম্বার থেকে ফোন আশা করিনি! তাই বুঝতে পারছিনা যে কি বলব!
কয়েকদিন থেকেই তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল, কিন্তু ফোন করার ঠিক সাহস পাচ্ছিলাম না।
কাল থেকে তোমার কন্ঠ শোনার খুব ইচ্ছে করছিল, তাই আজ সাহস করে ফোনটা করেই ফেললাম।
কেমন আছ তুমি ?
মানুষ বদলে যায় কিন্তু তাদের কন্ঠ বদলায় না।
হুম, আছি নিজের মত করে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি।
জিঞ্জেস করবে না আমি কেমন আছি ?
উহু, প্রয়োজন নেই। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় ভাল থাকে, তুমি হচ্ছ তাদের একজন।
(ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতা.......)
আমার কথা মনে পড়েনি তোমার?
হ্যা পড়েছে। অনেক মনে পড়েছে। যথন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতাম তখন মনে পড়ত "তুমি ঠিকমত খাচ্ছ তো!" যখন রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে, কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পড়তাম তখন মনে পড়ত "তুমি সুস্থ আছ তো!" যখন কোন আনন্দোত্সবে সবাই হই-চই আর আনন্দে মেতে উঠত আর আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকতাম তখন মনে পড়ত "তুমি সবারসাথে খুশি আর আনন্দে মেতে উঠছ তো!" যখন আয়নায় নিজের অযত্ন অবহেলায় শুকিয়ে যাওয়া চেহারাটার দিকে তাকাতাম তখন মনে পড়ত "তুমি নিশ্চই আরো সুন্দর হয়ে গেছ!" একসময় অনেক মনে পড়েছে। এখন আর পড়ে না। এখন এত সময় কই এগুলো মনে পড়ার?
(ওপাশে আবার নিরবতা ......)
আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?
ক্ষমা তো আমি তোমাকে পাঁচ বছর আগেই করে দিয়েছিলাম। তোমায় ক্ষমা না করলে আমার মনে তোমার দেয়া কষ্টগুলোর ক্ষত কোনভাবেই শুকাত না। আচ্ছা এখন তাহলে রাখি। এখন আমার আকাশ দেখার সময়। প্রতিদিন রাতে এইসময় আমি আকাশ দেখি। আকাশের সাথে কথা বলি। আকাশ কখনো আমার সাথে ছলনা করে না। প্রতি রাতে সে তারার ঝুলি নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়। আমি কথা বলি সে চুপচাপ শোনে।একটুও বিরক্ত হয়না।
একরাত আকাশের সাথে কথা না বললে হয় না? আমাদের কথা থেকে আকাশের কথা কি খুব বেশি জরুরী?
আপাতত তাই। আমার চরম অসহায়ত্ব আর একাকিত্বের সময় ঐ আকাশ আমায় সঙ্গ দিয়েছে। যে পাঁচ বছর আমায় দূরে সরিয়ে রেখেছিল তার জন্য আমি আমার পাঁচ বছরের পাশে থাকা সঙ্গীকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব না। আচ্ছা আমি এখন যাব। রাতের আকাশ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ খুব সুন্দর একটা চাঁদও উঠেছে আকাশে। আজ চাঁদের সাথেও কথা বলব.....
ফোনটা কেটে দিলাম।
বারান্দায় এসে দাড়ালাম।
আকাশের বুকে গোল একটা চাঁদ উঠেছে, তাকিয়ে আছি, খুব কষ্ট হচ্ছে।
সেই পাঁচবছর আগের মত কষ্ট যখন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। কি দোষ ছিল আমার? কেন চলে গিয়েছিলে? আজ ও তা আমি জানিনা। তারপরও অটুট বিশ্বাস, আশা ধরে রেখেছিলাম একদিন তুমি আসবে। আমি অপেক্ষা করব। করেছি, অনেক অপেক্ষা করেছি। ভেবেছিলাম যেদিন তোমার ফোন আসবে খুশিতে চিত্কার দেব। তোমার কাছে ছুটে চলে যাব। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় কিন্তু তুমি আসনি। কলেজ  পাশ করার পর দু-বছর হয়ে গেল। বাবা আমাকে অনেক ভালবাসে। সেই বাবাকে পর্যন্ত বলে দিলাম বিয়ে করব না।

বাবার দীর্ঘঃশ্বাস, দুঃখ ভরাক্রান্ত মন সবই উপেক্ষা করতাম। ঠিক পাঁচমাস আগে বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেল। ডাক্তার বললেন মাইনর অ্যাটাক। এই বয়সে এত টেনশন ওনার সাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাবার অসুস্থতার জন্য কোন না কোন ভাবে আমি দায়ী। কারণ বাবার সব টেনশন ছিল আমাকে নিয়ে। সারাদিন বাবার হাত ধরে বসে থাকতাম। বেশ কয়েকদিন পর বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "মা আমার, ­ জীবনের মনে হয় আর খুব বেশি দিন বাকি নেই। আমি সব সময় তোমাকে সুখী রাখতে চেয়েছি। মৃত্যুর আগেও আমি তোমাকে সুখী দেখে যেতে চাই। এটাই এখন আমার শেষ ইচ্ছা। একজন বাবা হিসেবে এর বেশি আর কিইবা চাওয়ার থাকতে পারে? মা, তুমি একবার ভেবে দেখ। ছেলেটা অনেক ভাল। তোমাকে অনেক সুখে রাখবে আমার বিশ্বাস। কোন তাড়াহুড়ো নেই।
ছেলেটার সাথে দেখা কর। তাকে বোঝার, চেনার চেষ্টা কর। তোমার পছন্দ না হলে কোন অসুবিধা নেই। শুধু তার সাথে দেখা করে, কথা বলে দেখ।
না, আর পারলাম না বাবার কথা অমান্য করতে। তার আকুতি ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করতে। বাবার পছন্দের ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা করলাম দেড় মাস আগে। ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু দেখে বোঝার উপায় নেই। খুব সাধাসিধে ধরণের মানুষ। কথার মারপ্যাঁচ ধরতে পারেন না। লোকটার মা নেই।

Related Posts

: