খোলো, দরজাটা খোলো বলছি, আমি বাইরে আসবো, ইতির বরকে দেখবো, খোলনা। ইতি আমি বরকে দেখবো। বলে চিৎকার করে কাঁদছে আমার বড় বোন রীতি আপু।
আপু গত সাতবছর ধরে মানসিক রোগী। মাঝে মাঝে একদম স্বাভাবিক হলেও বেশিরভাগ সময়ে অস্বাভাবিক থাকে। তখন কাউকেই চিনতে পারেনা, খুব ভাঙচুর করে আর চিৎকার করে কাঁদে। কখনও বা হাহা করে হাসে কারণ ছাড়াই। আপু আমাকে খুব ভালোবাসে আর হয়তো সেজন্যই সেইসব অস্বাভাবিক মুহূর্তগুলোতেও আমার নামটা ঠিক মনে রাখে।
আজ আমার এনগেজমেন্ট। আমার বাবার এক বন্ধুর মাধ্যমে ফ্যামিলিগত ভাবেই বিয়েটা ঠিক হচ্ছে। ছেলেপক্ষকে জানানো হয়নি যে আমার এক বোন আছে মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ। কারণ এর আগে বেশ কয়েকবার এই কারণেই আমার বিয়ে ভেঙেছে। তাই আজ ওই পক্ষ বাড়ীতে আসার আগেই আম্মু আপুকে রুমে বন্ধ করে রেখেছে।
যথাসময়ে এনগেজমেন্ট কমপ্লিট হলো। বিয়ের দিন আগামী সপ্তাহেই। আসলে আব্বু, আম্মু কোনও রিস্ক নিতে চান না যে আপুর কথা জেনে ফেলে ওরা বিয়েটা না ভেঙে দেয় তাই ওদের ব্যাপারে খুব একটা খোঁজ খবরও নেন নি শুধু আংকেল বলেছেন খুব বনেদী আর শিক্ষিত ফ্যামিলি।
ওরা চলে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে আপু রুম থেকে খুব জোরে চিৎকার করছে আর ভারী কিছু দিয়ে দরজা পেটাচ্ছে যেটা এর আগে আপু কোনওদিন করেনি, করলে হয়তো আম্মু ওকে কোনও কিছুর সাথে বেঁধে রাখতো এই সময়টা।
পাত্রের আম্মু জিজ্ঞাসা করলেন, কে চিৎকার করছে এমন করে!
আমরা কেউ কোনও জবাব দিতে পারিনি। সবাই মাথা নীচু করে কাঁদছি। ভাইয়া বেড়িয়ে গেল চোখ মুছতে মুছতে।
আব্বু বললেন, আমার বড় মেয়ে। ও একটু অসুস্থ তাই ওকে....
কিন্তু আপনারা তো বলেননি যে আপনাদের অসুস্থ, পাগল কোনও মেয়ে আছে। বললেন রিফাত সাহেবের আম্মু।
জ্বী, আসলে এর আগেও আমার ইতির কয়েকবার বিয়ে ভেঙেছে এই কারণে। ইতির পর মিতিকে বিয়ে দিতে হবে। মেয়েদের বয়সও বেড়ে যাচ্ছিল, তাই....
তাই আপনারা আমাদের সাথে চিট করে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছিলেন! বললেন রিফাত সাহেবের আব্বু।
দেখুন ভাইসাহেব, আমার রীতি অসুস্থ কিন্তু ইতি, মিতি তো অসুস্থ নয়। আর রীতি জন্ম থেকে এমনটা নয়। সাতবছর আগে কোনও একটা একসিডেন্টে প্রচন্ড মানসিক আঘাতে মেয়েটার আমার এই অবস্থা।
আম্মুর মুখে রীতি নামটা শুনে সবাই কেমন চমকে গেলেন বিশেষ করে রিফাত সাহেব।
কি নাম বললেন? রীতি!
আপনারা এখানে কত বছর থাকছেন একটু বলবেন?
মানে, এর আগে কি আপনারা খুলনাতে....
আপনারা এখানে কত বছর থাকছেন একটু বলবেন?
মানে, এর আগে কি আপনারা খুলনাতে....
রিফাত সাহেব কথা শেষ করার আগেই বাঁধা দেয় উনার আম্মু।
এসব কি জিজ্ঞাসা করছিস! এখানে আমি ছেলেকে বিয়ে করাবো না। বলেই তিনি তার ছেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিলেন।
হ্যাঁ বাবা, আমরা খুলনাতে ছিলাম। সাত বছর আগে ট্রান্সফার নিয়ে এখানে এসে ফ্ল্যাট কিনে থাকা শুরু করি। কিন্তু তুমি এসব কেন জানতে চাইছো?
আমি আপনাদের বড় মেয়ে রীতিকে একটু দেখতে চাই।
রিফাত কি হচ্ছে কি! তুমি কি যাবে এখন এখান থেকে বাড়ীতে?
রিফাত কি হচ্ছে কি! তুমি কি যাবে এখন এখান থেকে বাড়ীতে?
না আম্মু, প্লিজ, আমাকে বাঁধা দিওনা। তুমি জানো আমি কেন এমনটা করছি।
আব্বু, আম্মু রীতি আপুকে নিয়ে এলেন। আপুকে দেখে ও বাড়ীর সবাই ভড়কে গেলেন, তারমানে উনারা সবাই আপুকে আগে থেকেই চেনেন! কিন্তু কি করে! তবে কি আপুর জীবনের ভুলের সাথে এরা কোনও ভাবে জড়িত?
রিফাতসহেব একটু কাছে গিয়ে আপুকে রীতি বলে ডাক দিতেই আপুও কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। ও কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে গেল রিফাত সাহেবের ফ্যামিলির সবাইকে দেখে।
রিফাতসহেব আম্মুকে বললেন, রীতি আপুকে নিয়ে যেতে। আর উনি কথা বলতে চান একটা বিষয়ে।
তখন আমি সবে চাকরী শুরু করি। বাবার অঢেল আছে তবুও নিজের পায়ে তো দাঁড়াতেই হবে। ওদিকে রীতি তখন অনার্স ফাইনাল দিয়েছে আর ওর বাড়ী থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। আমি রীতিকে বলেছিলাম আমার কথা ওর ফ্যামিলিতে জানানোর জন্য। কিন্তু ওর এই বিয়েটা নাকি অনেক আগেই ওর আব্বু আর তাঁর বন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন যেটা রীতিকে জানানো হয়নি আগে কখনও। তবু রীতিকে বলি বাড়ীতে আমার কথা জানাতে কিন্তু ও আমাকে জানায় ফ্যামিলিতে ওকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ওর বিয়ে যার সাথে ঠিক করা আছে তাঁর সাথেই হবে। আমি তখন রীতির ফ্যামিলির ব্যাপারে খুব একটা জানতাম না। শুধু জানতাম ও ফ্যামিলিতে প্রথম সন্তান, ওর ছোট আরও দুটি বোন ইতি এবং মিতি আর এক ভাই আছে। সত্যি বলতে আজকের এই সম্বন্ধোটা ঠিক হবার সময় ইতি আর মিতি নামদুটো শুনেই আমার বেশী আগ্রহ হয় আপনাদের বাড়ী আসার। কারণ রীতির মুখে এই দুটো নাম খুব শুনেছি। মাত্রতো তিন মাসের এফেয়ার ছিল আমাদের তবে এই তিন মাসে কেউ কারও ফ্যামিলি খোঁজ না নিলেও দুজন দুজনকে খুব বুঝতে পারতাম, ভালোবাসতাম এটাই আমরা দাবী করতাম যদিও পরে বুঝেছি আমরা কেউ কাউকে ঠিকভাবে চিনিই নি, হয়তো আমিই চিনি নি রীতিকে, হয়তো চেনার জন্য সময়টা খুব কম ছিল, তা না হলে কেন সেদিন একটিবার রীতির কথা শুনিনি!
নিঃশ্বাস ফেলে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন রিফাত সাহেব, আমাদের বাড়ীতে যেহেতু সেসবের কোনও ঝামেলা ছিল না তাই আমি ওকে বিয়ে করে সোজা বাড়ী নিয়ে যাই। কিন্তু আব্বু ওকে খুব পছন্দ করলেও আম্মু আর আমার বোন কেন যেন ওকে পছন্দ করতো না। যদিও আমার সামনে সেটা প্রকাশ করতেন না কিন্তু ছয়মাসের বিবাহিত লাইফে রীতির বিভিন্ন কথায় সেটা বুঝতে পারতাম। তবুও একদম মন্দ চলছিল না আমাদের সংসার।
আমাদের ফ্ল্যাটের মেইন দরজার লকের চাবি আমার কাছেও থাকতো তাই আমি অফিস থেকে নিজেই দরজা খুলে ঘরে ঢুকতাম। সেদিন দুপুরে বাড়ীর সবার দাওয়াত ছিল তবে রীতি যাচ্ছেনা কারণ আমি যাচ্ছিনা। তাই মিটিং সেরে দুপুরেই বাড়ী ফিরে যথারীতি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে রীতিকে রুমে পেলাম না। হঠাৎ সিফাত, আমার ছোটভাইয়ের ঘর থেকে আওয়াজ পেয়ে সেখানে যাই, দরজা শুধু ভেজান ছিল, একটু ধাক্কা দিয়ে খুলে ওদের দুজনকে বাজে সিচুয়েশনে দেখে আমি দ্রুত বেড়িয়ে আসি। একটু পর ওরা আমার সামনে আসলে আমি চিৎকার করে সিফাতকে আর রীতিকে দুজনকে মারতে শুরু করি। ইতিমধ্যে সবাই দাওয়াত খেয়ে চলে এসে রীতিকে ছিঃ ছিঃ করতে থাকে। সিফাত আমার পায়ে ধরে বলে, রীতি ওকে প্রায় বিভিন্ন ইঙ্গিত করে আর আজ ও একটু আগে চলে আসায় ওর রুমে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। আর ছেলে মানুষ নিজের কন্ট্রোল রাখতে পারে নি। রীতি অবশ্য বারবার শুধু বলেছে, সিফাত মিথ্যে বলছে, সিফাত জোর করেই ওকে .....।
কিন্তু আমি সহ বাড়ীর সবাই কেউ বিশ্বাস করিনি কারণ ঘটনা সিফাতের রুমেই ঘটেছে আর রীতি ওই রুমে না গেলে নিশ্চয়ই জোর করে সিফাত নিয়ে যায়নি, এটাই ছিল আমাদের ভাষ্য।
ওদিকে আম্মু আর রুম্পা অনেক অভিযোগ করছিল রীতির বিরুদ্ধে। আমার তখন প্রচন্ড মাথা গরম হয় আর খুব মার দিই রীতিকে। মারতে মারতে রক্তাক্ত করে বেহুশ করে ফেলি, যেন আমি একটা জানোয়ার হয়ে গিয়েছিলাম।
ওর জ্ঞান ফিরলে ও আবার আমার কাছে আসে, আমি তখন ওকে বাড়ী থেকে বের করে দিই। বের করে দেবার পরও ও দুদিন পর্যন্ত বাগানে বসে থাকতো, কখন আমাকে পাবে। আর প্রতিবারই আমি ওকে ধীক্কার দিয়ে বের করে দিই। পরে হয়তো ও চলে যায় ওর আব্বু, আম্মুর কাছে।
ঘটনা বলতে বলতে রিফাত সাহেব হাঁপাচ্ছেন আর সাথে উনার দুচোখ টলটল করছিল তাই তিনি একটু থেমে আবারো বলতে শুরু করলেন.....
ওই ঘটনার ঠিক সাতমাস পরে একদিন সিফাতের রুমের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনছি, ও ফোনে কোনও বন্ধুকে বলছে, আরে বলিস না, কপালটাই খারাপ। আব্বু পর্যাপ্ত টাকা দেয়না যে মন ভরে একটু ফুর্তি করবো। যা ও ভেবেছিলাম, ঘরে রীতি ভাবীকে ট্র্যাপে ফেলে সেগুলো ভিডিও করে পরে সেই ভিডিও দেখিয়ে অন্তত কিছু হতো। কিন্তু প্রথমদিন ধরা পরে সেদিনই ভাবীকে বিদায় করল, অবশ্য আমি বেঁচে গিয়েছি দোষটা ওর ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়ে।
সিফাতের কথা শেষ হবার আগেই আমি সিফাতকে গিয়ে মারতে শুরু করি। সবাই চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে।
রীতি চলে যাবার দিন থেকে আব্বু খুব কেঁদেছেন আর ঐদিন সিফাতের আসল চেহারা বের হলে আব্বু বলেছিলেন, আমি কতবার তোমাদের বোঝাতে চেয়েছি রীতি অমন মেয়ে নয়, আমরা অন্যায় করেছি রীতির সাথে কিন্তু তোমরা কেউ সেদিন আমার কথা গ্রাহ্য করোনি, সিফাতকে প্রশ্রয় দিয়েছো। ওই মুহূর্তেই আব্বু সিফাতকে বাড়ী থেকে বের করে দেয় চিরদিনের জন্য। অবশ্য আম্মু আর মামা ওকে সহযোগীতা করে পরে বিদেশ পাঠিয়ে দেয় তবে আমার আর আব্বুর সাথে আজ অব্দি ওর কোনও যোগাযোগ হয়নি।
আমি সেদিনই রীতিকে খুঁজতে বের হয়ে যাই। ওর এক বান্ধবীর কাছে জানতে পারি ছয়মাস আগে ওরা ঢাকায় বদলি হয়ে যায় আর অনেক চেষ্টা করেও ঠিকানা জোগাড় করতে পারিনি। কয়েকমাস পর আমিও ঢাকায় এসে চাকরি নিই আর তিন বছর পর রুম্পার বিয়ে হয়ে গেলে আব্বু,আম্মুও ঢাকায় চলে আসেন।
ঘটনা বলে রিফাত সাহেব নিঃশব্দে কাঁদছেন, আমরাও কাঁদছি, আমার আপুটা এতো নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে যেটা আমরা জানতাম ই না।
আম্মু তখন বললো, বাবা, তোমরা আমার এতো সুন্দর, এতো ভাল মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত মানসিক রোগী বানিয়ে দিয়েছো!
সেদিন রাতে হঠাৎ রীতি বাড়ী এসে হাজির। ওর গায়ে অনেক মারের দাগ, জমাট বাঁধা রক্ত শরীরের বিভিন্ন জায়গায়, প্রচন্ড জ্বর। ডাক্তার দেখিয়ে একটু সুস্থ হলে ওকে অনেক জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পাইনি কারণ ও এসে থেকে একটি কথাও বলেনি, শুধু বলেছিল, আমাকে ওরা খুব মেরেছে, আমি কোনও অন্যায় করিনি।
এরপর কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করলাম ও খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছে। অনেক মানসিক ডাক্তার দেখিয়েও ঠিক করতে পারিনি।
রিফাত সাহেব হঠাৎ আম্মুর পায়ে পরে মাথা ঠুকতে লাগলেন। আম্মু উনাকে দাড় করালে উনি বললেন, আম্মু, আমি আমার রীতিকে যদি আবার নিতে চাই, আমাকে দেবেন আমার রীতিকে? ওকে ছাড়া যে আমিও ভাল ছিলাম না। এতো বছর পর আজ বিয়ের জন্য রাজী হয়েছিলাম রীতির মুখে শোনা নামগুলোর জন্য। তা না হলে আজও আসতাম না। প্লিজ মা, আমাকে দিন না, আমার রীতিকে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি ওকে আমার ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে ফেলবো। আমি অন্তত এভাবে আমার আর আমার পরিবারের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।
রিফাত সাহেবের কথায় আমরা সবাই কেঁদে ফেললাম। ঠিক হলো আগামী সপ্তাহে আপুর আর রিফাত ভাইয়ার আবার বিয়ে এবং রিসেপশন হবে।
এতদিন যতবার আমার বিয়ে ভেঙেছে ততোবার কেঁদেছি, আজ আবার আমার বিয়ে ভেঙে গেল, আজও খুব কাঁদছি তবে আজকের কান্না আমার জীবনে সবথেকে বেশী আনন্দের কান্না, খুশির কান্না।
রানু মোস্তফা।
: