গল্পের নাম:সন্ধিক্ষণ
পহেলা ফাল্গুনে এক প্যাকেট সিগারেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে ক্যাম্পাসের সবার সামনে সায়নী আমাকে প্রপোজ করেছিলো। বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম আমি। আমার মত এমন সাদাসিধে আনস্মার্ট ছেলেকে সায়নীর মত স্মার্ট সুন্দরী একটা মেয়ে প্রপোজ করতে পারে,এটা যেন আমার ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু সায়নীকে আমি সেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ সেই সময় আমার জীবনটা ছিল একটা যুদ্ধক্ষেত্র। ভালো রেজাল্ট নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মোটামুটি রকমের একটা চাকরী যোগাঢ় করাই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যে প্রেম ভালবাসা নামক ভাইরাস টেনে এনে কোনো আসক্তিতে জড়াতে চাইনি আমি। সেদিন সায়নীকে ফিরিয়ে দিতে পারলেও,সাতদিন পর যখন ওর অসুস্থতার খবর পেয়ে হসপিটালে ছুটে গিয়েছিলাম তখন ওর মলিন মুখখানা দেখে আর ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য আমার ছিল না। আপন করে নিলাম সায়নীকে। জড়িয়ে নিলাম আমার দূর্বিষহ জীবনের সাথে। কিন্তু তখনো আমি সায়নীকে পুরোপুরিভাবে ভালবাসতে পারিনি। শুধুমাত্র ভালোলাগা থেকে ওকে মেনে নিয়েছিলাম। তাছাড়া ওর মধ্যে এমন কিছু ছিল যা আমাকে প্রতিনিয়ত চুম্বকের মত আকর্ষণ করতো। দিনের পর দিন একটু একটু করে ওর সীমাহীন ভালবাসায় নিজের একটা আশ্রয় খুঁজতে শুরু করলাম। সায়নী আমাকে অসম্ভব রকমের ভালবাসতো। এমন ভালবাসা খুব কম ভাগ্যবানদের কপালেই জুটে। ওর ভালবাসার মধ্যে প্রচুর পাগলামিও ছিল। এই পাগলামিগুলোই আমাকে বাধ্য করতো ওকে আরো প্রশ্রয় দিতে।
আমার বাবা একজন কৃষক। অনেক কষ্ট করে তিনি আমার পড়াশোনার খরচ চালাচ্ছেন। আমার জন্য বাবার অনেক ধারদেনাও জমেছে। দুই ভাই,এক বোন আমরা। আমি সবার বড়। ভাই-বোন দুটো বাবা-মা'র সাথে গ্রামে থাকে। টানাটানির সংসার আমাদের। আমার পরিবারের ভবিষ্যৎ আমিই। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তারা দিন গুণছে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরীতে ঢুকে বাবার সব দেনা শোধ করবো,ভাই-বোনদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিব এমনটাই আশা করছেন বাবা-মা। এসব কিছু সম্পর্কের শুরুতেই সায়নীকে খোলাসা করে বলে দিয়েছিলাম। সায়নী তখন আমার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিলো,
"তোমার পরিবার তোমার দায়িত্ব। তোমার দায়িত্ব পালনে আমি কখনো বাঁধা দিবো না ধ্রুব। বরং আমি তোমার শক্তি হওয়ার চেষ্টা করবো সবসময়। আমি তোমাকে ভরসা দিবো। বিনিময়ে তুমি শুধু আমাকে নিশ্চয়তা দিও।"
তারপর সায়নী তার একটা হাত আমার হাতের মুঠোয় বন্দি করে নিলো। আর আমি চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
সায়নী আর আমি ক্লাসমেট ছিলাম। ক্লাস শেষে প্রতিদিন ক্যাম্পাসের লেকের পাড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নতুন নতুন স্বপ্নের জাল বুনা ছিল আমাদের রোজকার রুটিন। আমাদের উড়নচণ্ডী প্রেমের খবর পুরো ক্যাম্পাসে রটে গিয়েছিলো। সায়নী ছিল ক্যাম্পাসের সেরা সুন্দরীদের মধ্যে একজন। তাই অনেক ছেলেদের নজর ছিল ওর দিকে। একদিন ক্যান্টিনে বসে আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু মিলে চা খাচ্ছিলাম,এমন সময় দু'তিনজন সিনিয়র ভাইয়া এসে আমাকে শাসাতে শুরু করলেন; আমি যেন সায়নীকে ছেড়ে দিই। মুহূর্তেই এই খবর সায়নীর কাছে পৌঁছে গেল। আর সাথে সাথে সায়নী সিনেমার নায়কদের মত এন্ট্রি নিলো। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়াদের জিজ্ঞেস করলো,
- কি সমস্যা? কি হচ্ছে এখানে?
সায়নীকে দেখে বাঘ বিড়াল হয়ে গেল চোখের পলকে।
প্রতিউত্তরে সিনিয়রদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন,
- না মানে,তেমন কিছু না। ধ্রুব তো হোস্টেলে থাকে, তাই ওইখানে কোনো সমস্যা হইতেছে কিনা খবর নিতে আসছিলাম আর কি।
- ও আচ্ছা। না,ওর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আর ভবিষ্যতে যদি কোনো সমস্যা হয়ও,তাহলে ওর আগে আমি আপনাদের জানিয়ে দিয়ে আসবো। ঠিক আছে?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ঠিক আছে। আমরা তাহলে আসি।
বলা বাহুল্য,সায়নীকে প্রায় সব ছেলেরাই ভয় পেতো। কারণ ও ছিল খুব বদমেজাজি, রগচটা স্বভাবের। ওর সাথে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে কোনো ছেলে পার পেতে পারতো না।
বাবা আমাকে টিউশনি করতে না করেছিলেন পড়াশুনার ক্ষতি হবে বলে। বলেছিলেন; যত কষ্টই হোক,গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আমার সব খরচ চালাবেন। কিন্তু প্রতি মাসে বাবা যে টাকা পাঠাতেন,সেই টাকা দিয়ে আমার খরচ কোনোমতে চালিয়ে নিতে পারলেও,সায়নীর ছোটখাটো আবদারগুলো মেটাতে পারতাম না। ও কিন্তু খুব বেশি কিছু চাইতো না আমার কাছে। ওর চাওয়াগুলো ছিল অতি সামান্য। এই যেমন সপ্তাহে একদিন রিক্সায় চড়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো, মাঝেমধ্যে একগুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা,আর যখন তখন ফুচকা খাওয়ার বায়না পূরণ করা। ব্যস্,এই তো। তবে ও প্রায়ই আমাকে খরচ করতে মানা করতো।ওর কাছ থেকে নিতে বলতো। কিন্তু প্রেমিকার কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেয়া আমার ধাঁচে ছিল না। তাই বাবার নিষেধ অমান্য করে টিউশনি করতে শুরু করলাম। আমার জীবনটা তখন পুরোপুরিভাবে সায়নী নির্ভর হয়ে গেল। বন্ধুদের সাথে আড্ডা ছেড়ে দিলাম। খুব হিসেব করে সময় ব্যয় করতাম যেন পড়াশোনায় ব্যাঘাত না ঘটে আর আমি লক্ষ্যচ্যুত না হয়ে যাই। সারাদিন ক্লাস টিউশনি করে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে সন্ধ্যায় পড়তে বসে যেতাম। কারণ রাত জেগে ফোনে কথা বলতে হত সায়নীর সাথে। এমন অনেক রাত গিয়েছে,কথা বলতে বলতে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। আর সায়নী ফোনের ওপাশে একা একা বকবক করে যেত। যখন টের পেতো আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তখন সায়নীও লাইন না কেটেই ঘুমিয়ে পড়তো। এভাবে একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে শান্তির ঘুম ঘুমোতাম। এসব ছেলেমানুষী জানি কিন্তু সময়টাই ছিল এরকম।
বুকপকেটে সবসময় সায়নীর একটা সাদাকালো ছবি সাথে নিয়ে ঘুরতাম। মানিব্যাগ ব্যবহার করা এক ধরনের বিলাসিতা মনে হত তখন আমার কাছে। প্রচণ্ড রোদে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বুকপকেট থেকে সেই সাদাকালো ছবিটা বের করে যখন দেখতাম,হৃৎপিণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে যেতো। হতাশায় জর্জরিত আমার ক্লান্ত দূর্বল মনটাকে কাব্যিক প্রেমিকে রূপান্তরিত করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল এই ছবিটার।
একবার প্রায় দশদিনের মত ভাইরাস জ্বরে পড়েছিলাম। এই দশদিন সায়নী তার এক দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই সুমনের বাসায় আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো আমার সেবা করার জন্যে। প্রতিদিন সকালে আমার জন্যে রান্না করে নিয়ে আসতো। তারপর দিনভর চলতো তার সেবাশুশ্রূষা। জলপট্টি দেয়ার সময় সায়নীর চোখের পানি আমার গাল ছুঁয়ে যেত। তখন ইচ্ছে করেই ঘুমের ভান ধরে থাকতাম। টের পেতাম পাগলীটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মাঝেমাঝে খুব অবাক হতাম আমার প্রতি সায়নীর ভালবাসা দেখে। ভালবাসাবাসির প্রতিযোগিতায় আমি কখনোই সায়নীকে হারিয়ে দিতে পারতাম না। একদিন তীব্র কৌতূহল নিয়ে সায়নীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম,সে আমাকে এত কেন ভালবাসে! সায়নী মাথা নিচু করে কানের পাশে চুল গুঁজে দিয়ে মুচকি হেসেছিলো শুধু। খুব রেগে গিয়েছিলাম আমি। বলেছিলাম,
- আমার প্রশ্নটা কি হাস্যকর ছিল?
আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে সায়নী উত্তর দিয়েছিলো,
- বোকা বোকা প্রশ্নের উত্তরগুলোর সমাপ্তি মুচকি হাসি দিয়েই টানতে হয়, বুদ্ধু। ভালোবাসার কারণ খুঁজতে গেলে,ভালোবাসার পিপাসা মেটানো যায় না,বুঝলে!
সেদিন নিজেকে সত্যিকার অর্থেই নির্বোধ মনে হয়েছিলো আমার। তারপর...
হঠাৎ মোবাইলের অনাকাঙ্ক্ষিত রিংটোনে থেমে গেলেন ধ্রুব স্যার। আমিও যেন সম্বিত ফিরে পেলাম। এতক্ষণ ধ্রুব স্যারের গল্পের মাঝে ডুবে ছিলাম। মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে তিনি বললেন,
- আজ এ পর্যন্তই থাক। একটা জরুরী কল এটেন্ড করতে হবে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে এলাম আমি।
পুরোটা রাস্তা আমি ধ্রুব স্যারের ধ্যানে মগ্ন হয়ে ছিলাম। আশেপাশের রিক্সাগুলোর টুংটাং আওয়াজ,ফুটপাতের রোজকার কোলাহল,ফেরিওয়ালার হাকডাক এসব কোনোকিছুই আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না আজ।
বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম ভার্সিটির এসাইনমেন্ট করার জন্য কিন্তু মনোযোগ না আসায় এটা রেখে বন্ধুদের সাথে গ্রুপ চ্যাটে গেলাম। তাও কাজ হল না। ভেতরটা খুব ছটফট করছে ধ্রুব স্যারের প্রেমকাহিনীর শেষটুকু জানার জন্য। ঘরে মন টিকছে না একদম। আর থাকতে না পেরে চলে গেলাম মামার বাসায়। এই মুহূর্তে নেহাকে সব খুলে বলতে না পারলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব মনে হচ্ছে। নেহা আমার মামাতো বোন,আমার এক বছরের সিনিয়র।
মামার বাসা আর আমাদের বাসা একই এলাকায়। তাই প্রায় ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। সব কিছু শুনে নেহা বললো,
- আমি নিশ্চিত, ধ্রুব স্যার বিবাহিত। আর ওই সায়নী তার ওয়াইফ। কিন্তু আমার মনে হয় তারা সেপারেশনে আছেন এখন,নয়তো ডিভোর্স হয়ে গেছে তাই তিনি কাহিনীর শেষটুকু বলতে ইতস্তত বোধ করছিলেন।
আমাকে চুপসে যেতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেহা জিজ্ঞেস করলো,
- রঙ্গন,তুই কি লোকটাকে ভালবেসে ফেলেছিস?
খানিকক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলাম,
- জানি না। তবে তার সামনে গেলে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়,হাত পা অবশ হয়ে আসে,কণ্ঠনালী স্থির হয়ে যায়।
নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
- বয়সের ডিফারেন্স দেখেছিস? বি প্রাক্টিক্যাল রঙ্গন।
আমি পাত্তা না দিয়ে প্রতিউত্তর করলাম,
- মাত্র ৯ বছর।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি কিভাবে কি হয়ে গেল! অনুভূতিগুলো কত সহজেই মানুষটাকে আপন করে নিলো! এইতো সেদিনের কথা,আমি তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। নেহা "চন্দ্রবিন্দু" নামের একটা উপন্যাস আমার হাতে দিয়ে বললো,"পড়ে দেখ্, হারিয়ে যাবি একদম"।
সেই থেকেই আমার সর্বনাশের শুরু। উপন্যাসটার লেখক ছিলেন এই "সানজিদ হোসেইন ধ্রুব"। নেহার কাছে এই লেখকের বিভিন্ন বইয়ের কালেকশন ছিল। সবগুলো বই পড়ার পর লেখককে একবার সামনাসামনি দেখার তীব্র ইচ্ছে জেঁকে ধরলো আমাকে। দিশেহারা হয়ে পড়লাম লেখকের দেখা পাওয়ার জন্য। তার ফেসবুক আইডিতে কোনো ছবি ছিল না। তার প্রতিটা বইয়ের রিভিউ আমি মেসেঞ্জারে দিয়ে রাখতাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কখনো কোনো রিপ্লাই পেতাম না।
নেহার কাছ থেকে জানতে পারলাম,ধ্রুব ওদের দূরের আত্নীয় হয়। মামীর ফুফাতো বোনের ছেলে। এটা শুনে আমি যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মিইয়ে গেলাম,যখন শুনলাম ভদ্রলোক লোকসম্মুখে খুব একটা আসেন না। বইমেলাতে তার বইয়ের প্রচুর চাহিদা থাকে অথচ তিনি বইমেলাতেও আসেন না একবারও। তাছাড়া আত্নীয় হলেও ধ্রুব'র পরিবারের সংগে নেহাদের খুব একটা ঘনিষ্ঠতা নেই। আমার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে নেহা ধ্রুব'র সম্পর্কে আরো খোঁজখবর নিতে শুরু করলো। তখন জানা গেল,লিখালিখির পাশাপাশি তিনি খুব ভাল ছবিও আঁকেন। সাথে সাথে ছবি আঁকা শেখার ভূত চেপে গেল আমার মাথায়। প্রায় একমাস ঘ্যানঘ্যান করার পর আব্বু রাজি হলেন ছবি আঁকা শেখাতে। মামীকে বললেন,ধ্রুব স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু ভাগ্য আমাকে আবারও হতাশ করলো। ধ্রুব স্যার সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন,তিনি শখের বশে ছবি আঁকেন, কাউকে শেখান না। তারপরও অনেক অনুরোধের পর মামীর সুবাদে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই তবে বলেছিলেন,ছয়মাস পর আবার যোগাযোগ করতে,এখন তিনি বই লেখার কাজে ব্যস্ত আছেন তাই আপাতত তার হাতে সময় নেই।
দিন গুনতে শুরু করলাম তারপর থেকে। এরমধ্যে ভার্সিটিতেও ভর্তি হওয়া হয়ে গেল আমার।
অবশেষে ছয়মাস পর সপ্তাহে দু'দিন তার কাছে ছবি আঁকা শেখার সুযোগ পেলাম। প্রথম কিছুদিন মামী আমাকে নিয়ে যেতেন ধ্রুব স্যারের বাসায়। এভাবে আসা-যাওয়া হতে হতে মামীর সাথে ধ্রুব স্যারের মায়ের বোনের সম্পর্কটা আগের চেয়ে অনেকটা গাঁঢ় হয়ে গেল। পরিচয়ের প্রথমদিকে ধ্রুব স্যারকে আমি যেমন ভেবেছিলাম,তিনি আসলে তেমন না। ভেবেছিলাম মানুষটা খুব গম্ভীর,কথা বলে কম,হাসে কম,খুব সহজে কারো সাথে মিশে না। অথচ বাস্তবে তিনি খুবই হাসিখুশি এবং মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ। আবার এসবের মধ্যে তার ব্যক্তিত্ববোধটাও চোখে পড়ার মত। আর আউটলুকের ব্যাপারে বেশি কিছু বলবো না। শুধু বলবো মাশাল্লাহ্। তবে হ্যাঁ,তিনি নিজেকে আড়ালে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ভক্তসমাজের চেয়ে পাঠকসমাজের মূল্যায়ন তার কাছে অনেক বেশি।
পরিচয় হওয়ার আগে আমার ভালোলাগা শুধু তার লিখালিখি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। আর পরিচয় হওয়ার পর ব্যক্তি ধ্রুবকেও আমার মারাত্নকভাবে ভালো লাগতে শুরু করে।
আজ যখন ছবি আঁকা শেষ করে প্রতিদিনকার মতো খোশগল্পে মেতে উঠেছিলাম দুজন,তখন হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেছিলাম;
- আচ্ছা আপনার সব গল্পে নায়িকা চরিত্রের নাম সায়নী থাকে কেন? এর পেছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে নাকি?
তারপর তিনি রহস্যের জোট খুলতে শুরু করেছিলেন।
সারারাত আর ঘুম হয় নি আমার। পরদিন ধ্রুব স্যারের বাসায় নির্ধারিত সময়ের দু'ঘণ্টা আগে চলে গেলাম। জানি, আজ তার অফ ডে। সুতরাং বাসায়ই থাকবেন। কি করবো, তর সইছিলো না যে!
ধ্রুব স্যার মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
- কি ব্যাপার,আজ এত তাড়াতাড়ি আগমন। অন্য কোথাও প্রোগ্রাম আছে নাকি?
- ঠিক অন্য কোথাও না, অন্য কিছুর প্রোগ্রাম আছে।
- মানে?
- মানে আজ পুরো কাহিনী শুনে তারপর ক্লাস শুরু করবো।
কপালে ভাঁজ ফেলে ধ্রুব স্যার জানতে চাইলেন,
- কিসের কাহিনী?
- ভুলে গেলেন! কাল যেটা শুরু করেছিলেন,সেটা শেষ করেননি তো।
- ওহ্। এই কথা! আচ্ছা, স্থির হয়ে বসুন তো আগে। আমি আসছি।
খানিক বাদে দু'কাপ কফি নিয়ে এসে ধ্রুব স্যার আমার মুখোমুখি বসলেন,
- আসলে মাথাটা ধরেছিলো খুব। তাই...নিন ধরুন।
এক কাপ কফি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। তারপর নিজের কফিতে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করলেন,
- ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর পুরোদমে বিসিএসের জন্য প্রিপারেশন নিতে শুরু করলাম আমি। কারণ সায়নী বলেছিলো,বিসিএস ক্যাডার ছাড়া তার ফ্যামিলি বিয়ে দিবে না। সেই সময়টাতে সায়নীকে আগের মত সময় দিতে পারতাম না। কিন্তু এ নিয়ে সায়নীর কোনো অভিযোগই ছিল না। তাই নিশ্চিন্তে রাতদিন এক করে বিসিএসের পড়াশোনা করতে লাগলাম। ফাইনাল এক্সামের পর সায়নী জানালো,বাসা থেকে বিয়ের প্রেশার দিচ্ছে। আর বললো,খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরী যোগাড় করতে যেন বাসায় আমার কথা জানাতে পারে। খুব অস্থির হয়ে পড়লাম আমি। চাকরীর খোঁজে প্রতিদিন একবুক আশা নিয়ে ভোরবেলা বের হয়ে যেতাম,আর ফিরতাম একরাশ হতাশা নিয়ে। চোখের সামনে যে সারকুলার পেয়েছি,সেটাতেই সিভি দিয়েছি। ইন্টার্ভিউ দিতে দিতে কত জুতোর শুকতলা যে ক্ষয় করেছি,তার হিসেব নেই। একটা সিংগারা আর এক গ্লাস পানি দিয়ে অনেক বেহিসাবি দুপুর পার করেছি। কোনো এক অজানা কারণে সায়নীর সাথে আমার যোগাযোগ ক্রমশ কমে যেতে শুরু করলো।
হঠাৎ একদিন সায়নীর বেস্টফ্রেন্ড ইরা আমাকে কল দিয়ে বলে,
"ধ্রুব,তুমি সায়নীকে ভুলে যাও। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে।"
কথাটা বিশ্বাস করতে না পেরে ছুটে গিয়েছিলাম সায়নীর কাছে। পাক্কা তিনঘণ্টা ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার পর সন্ধ্যার সময় ওর দেখা পেয়েছিলাম আমি। সায়নী প্রথমে দেখা করতে চাইছিলো না। ওড়না দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে সে একটা চায়ের দোকানের আড়ালে নিয়ে গেল আমাকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে কড়াভাবে প্রশ্ন করেছিলো,
- কি সমস্যা তোমার? ইরা তোমাকে কিছু বলে নাই?
এত বছর সম্পর্কের মধ্যে এই প্রথম সায়নীর ক্রোধকাতর কণ্ঠ শুনলাম আমি।
- তুমি এমন কেন করছো সায়নী? খুব তাড়াতাড়ি একটা চাকরী হয়ে যাবে আমার,তুমি দেখে নিও। আর একটু অপেক্ষা করো প্লিজ।
- শুনো, এই অপেক্ষা করতে করতে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে আমার। তাছাড়া এখন আর আমার হাতে কিছু নেই। আব্বু ওদের কথা দিয়ে ফেলেছে।
- তাহলে আমাদের ভালবাসা? আমার ভালবাসার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?
- কিসের ভালবাসা? তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাসতা তাহলে এতদিনে ভাল স্যালারির একটা চাকরী যোগাড় করে আব্বুর সামনে গিয়ে দাঁড়াইতা। কম সময় তো দিই নাই তোমাকে,তাই না?
মানুষের জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,চেনা মানুষের অচেনা রূপ দেখার সময়। আমি সায়নীর অচেনা রূপটা দেখছিলাম আর মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম এটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন হয়। একটু থেমে সায়নী আবার বলতে শুরু করলো,
- দেখো ধ্রুব,তোমার সাথে কথা বলে নষ্ট করার মত সময় আমার হাতে নেই। তুমি এখন যাও এখান থেকে। তাছাড়া তোমার সাথে কেউ আমাকে দেখে ফেললে আমার মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে।
সায়নী চলে যেতে নিলে আমি তার হাত চেপে ধরলাম,
- আমার ভুলটা কোথায় ছিল বলে যাও।
সায়নী এবার আমার খুব কাছে চলে আসলো। বললো,
- তোমার কোনো ভুল ছিল না তবে অপারগতা ছিল। তুমি আমাকে কখনো এন্টারটেইন করতে পারো নি। ভেবে দেখো তো,এত বছরের সম্পর্কে তুমি কি আমাকে কখনো একটা লিপকিস পর্যন্ত করেছো? জড়িয়ে ধরা তো দূরে থাক। এই যুগে শুধু ভালবাসার আকর্ষণ দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না,শারীরিক আকর্ষণেরও দরকার হয়।
আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। থমকে গিয়ে সায়নীর যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম।
আমার জীবনের ছন্দপতনটা এত সহজে মেনে নিতে পারছিলাম না। এতটা অসহায় করে মাঝপথে সায়নী আমাকে ছেড়ে চলে যাবে,এ আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি কখনো। ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিলাম। রাতের পর রাত চাপা কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দিয়েছি নিকোটিনের কালো ধোঁয়ায়।
ফ্রেন্ডদের মাধ্যমে জানতে পারলাম সায়নীর যার সাথে বিয়ে হচ্ছে,সে আমাদের ভার্সিটির সিনিয়র ভাই জুনায়েদ। কানাঘুষায় জানতে পারলাম,জুনায়েদের সাথে নাকি বেশ কিছুদিন ধরে সায়নীর ঘনিষ্ঠতা চলছিলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না,আমার ব্যস্ততার সময়গুলোতে সায়নী জুনায়েদের সাথে ইনভলভ হয়েছিলো। নিজেকে শান্তনা দিলাম এই বলে যে,কামশাস্ত্র দিয়েও আমি সায়নীর কামনা মেটাতে পারতাম না কারণ তার ভালবাসাটা অন্যের জন্য তোলা হয়ে গেছে।
বাস্তবতাকে একসময় মেনে নিতে শিখে গেলাম। কিন্তু সারাদিন যেমনতেমন করে কাটিয়ে দিলেও রাতে আর ধরে রাখতে পারতাম না নিজেকে। তাই এ সময়টাতে আমার আর্তনাদগুলোকে কাগজে কলমে শব্দে রূপান্তরিত করতে শুরু করলাম। আর তারপর সেই শব্দগুলো হয়ে যেত একেকটা জীবনের গল্প। এভাবেই আমি লিখালিখির জগতে পা রেখেছিলাম।
প্রয়োজনীয়তা যেমন আবিস্কারের জনক,ঠিক তেমনি আমি মনে করি "ব্যর্থতা সফলতার জনক"। সায়নীর বিয়ের কিছুদিন পরেই একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করি,যেটাতে এখনো আছি। তারপর এই ফ্ল্যাটটা কিনে বাবা-মা,ভাই-বোন সবাইকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। ব্যস্,এইতো।
আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনে ধ্রুব স্যার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
- এ কি! আপনি কাঁদছেন কেন?
নাক টানতে টানতে পালটা প্রশ্ন করলাম আমি,
- আপনি নিশ্চয়ই এখন আর কোনো মেয়েকে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারেন না?
- তো?
- আপনার নিশ্চয়ই এখন ভালবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে?
- তো?
- উঁহু, বুঝবেন না আপনি।
ধ্রুব স্যারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি উঠে চলে আসলাম।
বাসায় এসে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি চিটাগাং চলে যাব ছোট ফুপির কাছে। আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। বুঝে গেলাম,ধ্রুব স্যারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান ছাড়া অন্য কিছু আশা করা বোকামি। কিন্তু এখানে থাকলে তাকে আমি কখনোই ভুলতে পারবো না। এখন থেকে মানুষটার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিবো। আমার এ সিদ্ধান্তের কথা নেহাকেও জানিয়ে দিলাম। আব্বু আম্মুও আপত্তি জানালেন না।
টানা ১৫ দিন সত্যি সত্যিই ধ্রুব স্যারের সাথে আমি আর কোনো যোগাযোগ করিনি। আজ সকাল ৮ টার ট্রেনে আমার চিটাগাং যাওয়ার কথা ছিল। অথচ শুধুমাত্র ঘুমের কারণে ট্রেনটা মিস করলাম। আব্বু নাকি এসে অনেকবার ডেকে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি উঠি নি।
ঘুম থেকে উঠে দেখলাম বাইরে তুমুল বৃষ্টি। আচমকা আমার শখ জাগলো, নিজের হাতে খিচুড়ি আর ঝাল গরুর মাংস রান্না করে ধ্রুব স্যারকে খাওয়াতে। যেই ভাবা সেই কাজ। দেরী না করে কোনোরকম ফ্রেশ হয়ে খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না করে নিয়ে রওনা দিলাম ধ্রুব স্যারের বাসার উদ্দেশ্যে।
কলিংবেল প্রেস করতেই দরজা খুলে দিলেন ধ্রুব স্যারের মা। আমাকে দেখে ভেতরে আসতে বললেন আর জিজ্ঞেস করলেন,
- এতদিন আসো নাই যে? আর আজকে যে তুমি আসবা,এইটা ধ্রুব জানে? ও তো টিভিতে একটা খবর দেইখা সেই যে দরজা বন্ধ কইরা ঘরের ভেতর ঢুইকা বইসা রইছে,আর তো খোলার নাম নাই।
কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম,
- কি খবর আন্টি?
- আজকে সকাল ৮ টার চিটাগাংগামী একটা ট্রেন এক্সিডেন্ট করছে।
- আমি কি স্যারের রুমে যেতে পারি একবার?
- হ্যাঁ আসো আসো। ডাইকা দেখো দরজা খুলে কিনা।
ধ্রুব স্যারের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে ডাক দিতেই তিনি দরজা খুলে দিলেন,
- আপনার না আজ চিটাগাং যাওয়ার কথা ছিল?
কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন ধ্রুব স্যার। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে তার। কেউ দেখলে মনে করবে,এইমাত্র কেঁদে এসেছে।
- আপনাকে কে বলেছে?
- নেহা।
রুমের ভেতরে ঢুকে গেলাম আমি। পিছু পিছু ধ্রুব স্যারও আসলেন। সেন্টার টেবিলের উপর খাবারের বক্সটা রেখে রান্নাঘর থেকে একটা প্লেট আর চামচ নিয়ে আসলাম। এসে দেখলাম,ধ্রুব স্যার দু'হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সোফার উপর চুপচাপ বসে আছেন। তারপর প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললাম,
- ঘুম থেকে উঠতে দেরী হওয়ায় ট্রেন মিস করেছি। কাল যাব চিটাগাং। তাই যাওয়ার আগে শেষবারের মত আপনার সাথে দেখা করতে চলে এলাম।
খাবারের প্লেটটা ধ্রুব স্যারের সামনে এগিয়ে দেয়ার সময় টের পেলাম,তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। হাটু গেড়ে তার মুখোমুখি বসলাম আমি,
- আপনি কাঁদছেন?
মুখ থেকে হাত নামিয়ে আমার মুখটা দু'হাত দিয়ে আঁজলা ভরে ধরলেন তিনি,
- তুমি জানো,খবরটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম আমি? পুরো পৃথিবীটা শূণ্য হয়ে গিয়েছিলো আমার। তোমার এই ক'দিনের অনুপস্থিতি আমার কলম থামিয়ে দিয়েছে,রংতুলির খেলা বন্ধ করে দিয়েছে। আরে আমিও যে মনে মনে তোমাকে কত চেয়েছি,সে খবর তো তুমি জানো না! মেসেঞ্জারে দেয়া তোমার প্রতিটা মেসেজ বারবার পড়তাম আমি। এক ধরনের অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করতো তোমার প্রতি। কিন্তু প্রকাশ করতাম না,ভয় হত খুব। যদি আবারও আরেকটা ধাক্কা খাই! কেন আমাকে এত কষ্ট দিলে? কিভাবে ভাবতে পারলে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা?
বিস্ময় আর প্রাপ্তির সুখ; দুটো অনুভূতি একসাথে কাজ করতে শুরু করলো আমার। দু'চোখ আমার ছলছল করছে বুঝতে পারছি।
ধ্রুব'র কাঁপা কাঁপা ঠোঁটজোড়া যখন আমার ঠোঁটের খুব কাছাকাছি,তখন অনুভব করতে পারলাম,
"অনুভূতিটা চুমু খাবার পরে নয়,ঠোঁটের কাছে ঠোঁট আনার আগ মুহূর্তে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতায়।"
: